জিন্নাহর জীবনে ছাপ ফেলা নারীরা

বোন ফাতিমা ও মেয়ে দিনার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহছবি: এএফপি

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান বলেছিলেন, যেকোনো পুরুষের সাফল্যের পেছনে একজন ভালো নারীর অবদান থাকে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জীবনের সঙ্গে ম্যাকমিলানের উক্তি মিলে যায়। তবে এই নারীরা তাঁর ‘পেছনে’ ছিলেন না বরং তাঁর ‘সঙ্গে’ চলেছেন।

জিন্নাহর জীবনে অনেক নারীর অবদান রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজনের কথা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ নারীদের সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। এমনকি জিন্নাহর মা মিথিবাই সম্পর্কেও খুব বেশি জানা যায় না। জিন্নাহর জীবনী গ্রন্থ ‘জিন্নাহ: ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান’-এও তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন সূত্র ধরে ২৫ ডিসেম্বর জিন্নাহর জন্মদিনে একটি লেখা প্রকাশ করে পাকিস্তানের পত্রিকা ডন।

জিন্নাহর মা: মিথিবাই

জিন্নাহর মার মিথিবাইয়ের জন্ম ইসমাইলি পরিবারে। এই পরিবারের বসবাস কাথিয়াওয়ার অঞ্চলের ধাফফা গ্রামে। ১৮৭৪ সালে তাঁর বিয়ে হয়েছিল জিন্নাভাইয়ের সঙ্গে। পারিবারিকভাবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। জিন্নাভাই ছিলেন গোনদালের বাসিন্দা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মা-বাবার বৈবাহিক জীবন কেমন ছিল, তা ধরা পড়ে জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহর বই থেকে। ‘মাই ব্রাদার’ নামে ওই বইতে তিনি লিখেছেন, বাবার সব মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলেন মা। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সেই এই দম্পতি করাচিতে পাড়ি জমান।

মিথিবাইকে যখন বিয়ে করেন, তখন উঠতি ব্যবসায়ী ছিলেন জিন্নাভাই। এরপর করাচিতে এসে তাঁদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। ছোট্ট দুই রুমের একটি বাসায় থাকতেন তাঁরা। মিথিবাই সেই সময় বেশ সাহস এবং উদ্যম নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এ করাচিতে তাঁর প্রথম সন্তান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম হয়। যাঁকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভালোবেসে গেছেন মিথিবাই। ছেলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে মা মিথিবাইয়ের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা নিয়েও কথা বলেছেন ফাতিমা। তিনি বলেন, ‘মা জিন্নাহকে খুব পছন্দ করতেন। সাত ভাইবোনের মধ্য জিন্নাহকে বেশি পছন্দ করতে তিনি। মিথিবাইয়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।’ মিথিবাই বলেছিলেন, তাঁর ছেলে জিন্নাহ অনেক বড় হবে। সে হবে সবচেয়ে চতুর। অন্য সন্তানদের তুলনায় সে ভালো কিছু করবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ মনোযোগী ছিলেন মা মিথিবাই।

১৬ বছর বয়সে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে পড়াশোনার জন্য। কিন্ত মা তাঁর সবচেয়ে পছন্দের সন্তানকে ছেড়ে দিতে কোনো দ্বিধা করেননি। কারণ, তিনি আশা করতেন, জিন্নাহ জীবনে সফল হবে। তাই জিন্নাহ যখন লন্ডনে যান, তখন মিথিবাই বলেছিলেন, ‘তুমি লন্ডনে যাচ্ছ সেটা আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি এটা নিশ্চিত যে এই ইংল্যান্ডে যাওয়া তোমার মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।’ জিন্নাহ যখন লন্ডনে পড়ছিলেন, তখনই তাঁর মা মারা যান।

মিথিবাইকে করাচিতেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে, তা জানা যায়নি।

ফুফু: মানবাই

ফুফু মানবাই জিন্নাহকে তাঁর ছেলের মতো ভালোবাসতেন। মানবাইয়ের বিয়ে হয় এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নাম পিরভাই। তাঁরা থাকতেন ভারতের মুম্বাইয়ে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ তাঁর ফুফু সম্পর্কে বলেছেন, মানবাই অসাধারণ গল্প বলতে পারতেন। ফাতিমা বলেন, রাতের পর রাত তিনি গল্প বলতেন। তখন মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতেন মানবাই।

মানবাইকে বেশ পছন্দ করতেন জিন্নাহ। এ কারণে ১৮৮৭ সালে করাচি ছেড়ে মুম্বাইয়ে চলে যান তিনি। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি ওলপার্ট ‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’ বইতে লিখেছেন, জিন্নাহ তাঁর ফুফু মানবাইকে অনুসরণ করতেন।

জিন্নাহকে মুম্বাইয়ের স্কুলে ভর্তি করেছিলেন মানবাই। তাঁকে মুম্বাইয়ের জীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মানবাই। এরপর লন্ডন থেকে ফিরে এই শহরেই জিন্নাহ ছিলেন।

প্রথম স্ত্রী: এমিবাই

১৫ বছর বয়সে জিন্নাহ বিয়ে করেন। ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমিবাইকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের দিনের দৃশ্য উঠে এসেছে ফাতিমা জিন্নাহর লেখায়। তিনি লিখেছেন, বিয়ের দিন এমিবাই দামি পোশাক পরেছিলেন। পরেছিলেন ভারী অলংকার। হাত ছিল মেহদিতে রাঙা। তাঁর মুখ-পোশাক জ্বলজ্বল করছিল।

বিয়ের এক বছর পর জিন্নাহ লন্ডনে যান। এর কিছুদিন পর এমিবাই মারা যান। আর এই ঘটনা জিন্নাহকে বেশ মর্মাহত করেছিল। এরপর জিন্নাহ প্রায় ২৫ বছর একা ছিলেন।

এমিবাই গ্রাম থেকে উঠে আসা এক মেয়ে। তিনি লজ্জা পেতেন। এমনকি শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সামনেও ‘পর্দা করতেন’। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না এমিবাইয়ের সম্পর্কে।

দ্বিতীয় স্ত্রী: রতনবাই

১৯১৮ সালে জিন্নাহ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তখন জিন্নাহর বয়স ৪২ বছর। আর যাঁকে বিয়ে করেন, সেই রতনবাইয়ের বয়স ছিল ১৮ বছর। এ দুজনের বয়সের যেমন পার্থক্য ছিল, তেমনি দুজন ছিলেন দুই ধর্মের। এ নিয়ে ১৯১৮ সালের ১৯ এপ্রিল ডেইলি স্টেটসম্যান অব কলকাতায় একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল। এতে লেখা হয়েছিল, স্যার দিনশার একমাত্র মেয়ে রতনবাই গতকাল ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে আজ তাঁর বিয়ে হবে। এই বিয়ের এক বছর পর জিন্নাহ ও রতনবাইয়ের মেয়ে দিনার জন্ম হয়। সাহিত্য ও শিল্পকলা নিয়ে আগ্রহ ছিল রতনবাইয়ের। এ প্রসঙ্গে ‘দ্য জিন্নাহ অ্যান্থোলজির’ লেখক শরিফ আল-মুজাহিদ লিখেছেন, জিন্নাহর জন্য নতুন একটি দিগন্ত খুলেছিলেন রতনবাই।

জিন্নাহ ও রতনবাইয়ের যৌথ জীবন কেমন ছিল, তা উঠে আসে একটি চিঠিতে। এ চিঠি লিখেছিলেন রতনবাই। এই চিঠিকে রোমান্টিক সাহিত্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ওই চিঠিতে রতনবাই লিখেছিলেন, ‘প্রিয়তম, তুমি যা করেছ তার জন্য ধন্যবাদ। ... আমাকে মনে রেখ প্রিয়, যেমন করে একটি ফুল তুমি বাগান থেকে তুলে যত্ন করে রাখ।.....’ এরপর ২৯তম জন্মদিনে তিনি মারা যান।

আল-মুজাহিদ লিখেছেন, রতনবাইয়ের মরদেহ যখন কবরে নামানো হচ্ছিল, তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি জিন্নাহ। শিশুর মতো কাঁদছিলেন তিনি। এ ছাড়া রতনবাইয়ের মৃত্যুর পর আর কাউকে বিয়ে করেননি জিন্নাহ।

বোন ফাতিমার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
ছবি: এএফপি

বোন: ফাতিমা জিন্নাহ

ফাতিমা জিন্নাহর পিতৃতুল্য বড় ভাই ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৮৯৩ সালে ফাতিমার জন্ম হয়। অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৭ বছরের ছোট ছিলেন ফাতিমা। ফাতিমার যখন জন্ম হয়, তখন তিনি লন্ডনে ছিলেন। বাবা যখন মারা যান, তখন ফাতিমার বয়স ৮ বছর। লন্ডন থেকে ফিরে পুরো পরিবারকে মুম্বাইয়ে নিয়েছিলেন জিন্নাহ। এ সময় ফাতিমার পড়াশোনাসহ যাবতীয় সবকিছু খেয়াল রাখতেন জিন্নাহ। রতনবাইকে বিয়ের করার আগপর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে থাকতেন ফাতিমা। ভাইয়ের কাছে আট বছর ছিলেন তিনি। ফাতিমা যখন মুম্বাইয়ে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, তখনো সাহায্য করেছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

১৯২৯ সালে রতনবাই মারা যান। এরপর ক্লিনিক বন্ধ করে আবারও ভাইয়ের বাসায় চলে আসেন ফাতিমা। দিনার দেখাশোনা করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মৃত্যু পর্যন্ত দিনার দেখাশোনা করেছেন ফাতিমা। রাজনীতিতেও ফাতিমার অবস্থান ছিল জোরালো। ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে তিনি উপস্থিত থাকতেন। ১৯৪৭ সালে করাচি ক্লাবে এক বক্তব্যে জিন্নাহ বলেন, ফাতিমা তাঁকে নিয়মিত সাহায্য করেন এবং প্রতিনিয়ত উৎসাহ জোগান।

মেয়ে দিনার সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
ছবি: সংগৃহীত

মেয়ে: দিনা

১৯১৯ সালের ১৫ আগস্ট দিনার জন্ম। ৯ বছর বয়সে মাকে হারান দিনা। এরপর ফুফু ফাতিমা ও বাবার কাছে বড় হয়েছেন তিনি।

মায়ের মৃত্যুর পর দিনাকে নিয়ে লন্ডনে চলে যান জিন্নাহ। সেখানে আবারও আইন পেশায় যুক্ত হন তিনি। মুম্বাইয়ের শিল্পপতি নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেছিলেন দিনা। নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করতে চাইলে বাবা জিন্নাহর সঙ্গে দিনার মতবিরোধ তৈরি হয়। আল-মুজাহিদ লিখেছেন, এর মধ্য দিয়ে জিন্নাহর পারিবারিক জীবনের ইতি ঘটে।

এই বিয়ে নিয়ে দিনার অবশ্য যুক্তি ছিল। তাঁর যুক্তি ছিল, জিন্নাহও তো একজন অমুসলিমকে বিয়ে করেছেন। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে, জিন্নাহ ও রতনবাই দুই ধর্মের ছিলেন। এই বিয়ের কারণে সারা জীবন তাঁদের কষ্ট পেতে হয়েছে। মেয়েকে এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন জিন্নাহ। দিনার এই বিয়ের পর বাবা-মেয়ের সম্পর্কে বেশ আনুষ্ঠানিক হয়ে গিয়েছিল। কারণ, মেয়েকে ‘মিস ওয়াদিয়া’ বলে সম্বোধন করতেন তিনি।

বন্ধু: সরোজিনী নাইডু

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বন্ধু খুব কম ছিল। তাঁর একমাত্র নারী বন্ধু ছিলেন সরোজিনী নাইডু। যিনি ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। সরোজিনী ছিলেন কবি ও রাজনীতিক। কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতার পর নেহেরু সরকারের উত্তর প্রদেশের গভর্নর হয়েছিলেন তিনি। জিন্নাহকে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। জিন্নাহর মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরোজিনী নাইডু মারা যান।

*ডন অবলম্বনে মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল