কেনজাবুরো ওয়েকে বলা হয় বলিষ্ঠ সত্তার এক নিভৃতচারী সাহিত্যিক। সস্তা প্রচার থেকে দূরে ছিল তাঁর অবস্থান। জীবনে যেটাকে তিনি সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কোনোরকম আপস তিনি কখনো করেননি। পাশাপাশি নিজের সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর মার্কিন সাময়িকী নিউইয়র্কারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ওয়ে লিখেছিলেন, ‘পারমাণবিক চুল্লি তৈরি এবং তা প্রদর্শন করার মধ্য দিয়ে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে মানবজীবনের প্রতি অসম্মান দেখানো হবে হিরোশিমার আণবিক বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের প্রতি সম্ভাব্য নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতা।’ এই বিশ্বাসে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটল থেকে জাপানকে পরমাণুমুক্ত করার নাগরিক আন্দোলনে নিজেকে তিনি সব সময় সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
ওয়ের আরেকটি অটল বিশ্বাসের দিক ছিল, জাপানের যুদ্ধ পরিহার করা সংবিধানের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা। জাপানের শাসকগোষ্ঠী যখন একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সংবিধানের যুদ্ধ পরিহারের নবম ধারা বাতিলের পাঁয়তারা শুরু করছিল, তখন থেকেই ওয়ে এর বিরোধিতাই কেবল করে যাননি, শান্তির সংবিধান বজায় রাখার জন্য নাগরিক পর্যায়ের বিভিন্ন আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
কেনজাবুরো ওয়ের জন্ম ১৯৩৫ সালে পশ্চিম জাপানের এহিমে জেলায়। লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তীতে জাপানের সামনে দেখা দেওয়া কঠিন এক সময়ে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করার সময় থেকেই বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর লেখা বিদগ্ধজনের নজর আকর্ষণে সক্ষম হয় এবং ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত ছোটগল্প ‘শিকারের’ জন্য দেশের নেতৃস্থানীয় আকুতাগাওয়া সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি। শিকার গল্পে শিকোকু দ্বীপে আটক অবস্থায় থাকা এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন যুদ্ধবন্দী এবং তাঁকে ঘিরে স্থানীয় বালকদের মধ্যে দেখা দেওয়া উৎসাহের চমৎকার বর্ণনা লেখক তুলে ধরেছেন।
১৯৬০–এর দশকের শুরুর দিকে কেনজাবুরো ওয়ে আণবিক বোমার ক্ষয়ক্ষতির বিস্তৃতি সম্পর্কে সরাসরি ধারণা পাওয়ার জন্য হিরোশিমা সফর করেন। সেই সফরের অভিজ্ঞতার ওপর লেখা তাঁর বই ‘হিরোশিমা ডায়েরি’তে লেখকের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
ওয়ের বেশ কিছু উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিদেশের পাঠকদের কাছে পৌঁছে গেলেও সস্তা জনপ্রিয় লেখক তিনি না হওয়ায় তাঁর পরিচিতির গণ্ডি ছিল অনেকটাই সীমিত। তাঁর যে একটি উপন্যাস বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়, সেটা হচ্ছে ‘নীরব কান্না’।
পারিবারিক জীবনে নিজের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলের প্রতি মমতা আর স্নেহ প্রদর্শনের অনন্য এক দৃষ্টান্ত ওয়ে দেখিয়ে গেছেন। সেই ছেলে একসময় সংগীত রচয়িতা হয়ে ওঠে এবং ছেলের সেই সাফল্য বাবাকে কতটা আপ্লুত করেছিল, তার প্রমাণ পাঠকেরা পেয়েছেন ওয়ের রচিত বই ‘পারিবারিক বিষয়ে’।
প্রায় দুই দশক আগে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিজের মায়ের জীবনের চমৎকার এক অধ্যায়ের বর্ণনা ওয়ে দিয়েছিলেন।