পৃথিবীতে যত পানি আছে, তার ৩ শতাংশ মিঠাপানি। পান করার জন্য ও কৃষিকাজে ব্যবহার করার জন্য মিঠাপানির বিকল্প নেই। আর এই মিঠাপানির বড় উৎস হলো হ্রদ। আকার-আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর সব হ্রদ সমান নয়। কিছু কিছু হ্রদ অনেক বড়। আবার কিছু হ্রদ অনেক গভীর। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ১০টি হ্রদ হলো—কাস্পিয়ান সাগর, সুপিরিয়র হ্রদ, ভিক্টোরিয়া হ্রদ, হুরন হ্রদ, মিশিগান হ্রদ, টাঙ্গানিকা হ্রদ, বৈকাল হ্রদ, গ্রেট বিয়ার হ্রদ, মালাবি হ্রদ ও গ্রেট স্লেভ হ্রদ। এই ১০টি হ্রদের মধ্যে কয়েকটি আবার বিশ্বের মোট হিমায়িত পানির ২০ শতাংশ ধারণ করে। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের তালিকা অনুযায়ী, আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি হ্রদ সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্প-সংস্কৃতির একটি স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে এসেছে কাস্পিয়ান সাগর। নামের সঙ্গে সাগর থাকলেও এটি আসলে হ্রদ। তাও আবার যেনতেন হ্রদ নয়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ হ্রদ। ৩ লাখ ৭১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত কাস্পিয়ান সাগর। এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সীমানা হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিস্থিতি ও আশপাশের এলাকার বাস্তুতন্ত্রের ওপর এটি প্রভাব ফেলছে। কাস্পিয়ান সাগরে মিঠা ও লবণাক্ত—দুই রকমের পানিই আছে। রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমিনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজান—এই পাঁচ দেশকে স্পর্শ করেছে বিশালাকারের এই হ্রদটি। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে হ্রদটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত।
উত্তর আমেরিকার গ্রেট লেকসের মধ্যে যে কয়টি হ্রদ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সুপিরিয়র। হ্রদটি ৮২ হাজার ১০৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। হ্রদের দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্র, উত্তরে কানাডার অবস্থান। এই হ্রদের গভীরতাও উল্লেখযোগ্য। এর গড় গভীরতা ১৫২ মিটার (৫০০ ফুট)। সর্বোচ্চ গভীরতা ৪০৬ মিটার (১ হাজার ৩৩২ ফুট)। ডুলুথ, থান্ডার বে–সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের অবস্থান এই হ্রদের তীরে। সেন্ট লরেন্স সমুদ্রপথের মাধ্যমে হ্রদটি আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এটি জাহাজ চলাচলেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।
মিঠা পানির এই হ্রদটির অবস্থান পূর্ব আফ্রিকায়। ৬৯ হাজার ৪৮৪ বর্গকিলোমিটারের হ্রদটি উগান্ডা, কেনিয়া ও তানজানিয়া—এই তিন দেশের মধ্যে পড়েছে। আঞ্চলিক জলবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই হ্রদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এটি নীল নদের একটি বড় উৎস। হ্রদের বিশাল এলাকা পরিবহন খাতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তবর্তী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও চলাচলের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। হ্রদটি আয়তনে বড় হলেও খুব বেশি গভীর নয়। এটির গড় গভীরতা ৪০ মিটার বা ১৩০ ফুট।
হুরন হ্রদ উত্তর আমেরিকার গ্রেট লেকসের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ। এটি ৫৯ হাজার ৫৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে হুরন হ্রদের অবস্থান। এটি বাণিজ্যিকভাবে মাছ শিকারের একটি কেন্দ্র। সেখানে ৩০ হাজার দ্বীপ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটির নাম ম্যানিটুলিন দ্বীপ। টার্নিপ রকের মতো বেশ কিছু আকর্ষণীয় ভূতাত্ত্বিক গঠন হ্রদটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করে তুলেছে।
মিশিগান হ্রদ ছাড়া বিশ্বের বড় হ্রদগুলোর কোনো তালিকাই যেন পরিপূর্ণ হয় না। ৫৭ হাজার ৭৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হ্রদটি বিস্তৃত। হ্রদটি অনেক গভীর। এটি উত্তর আমেরিকার পাঁচটি গ্রেট লেকের একটি। হ্রদটির পুরোভাগই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। মিশিগান হ্রদ যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান, ইন্ডিয়ানা, ইলিনয়, উইসকনসিনসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে পড়েছে। এই হ্রদের কূলে শিকাগো, মিলওয়াকির মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের অবস্থান। আর এই কারণে হ্রদটি জাহাজ চলাচল ও ভ্রমণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মিঠা পানির হ্রদ। হ্রদটি বুরুন্ডি, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো, তানজানিয়া ও জাম্বিয়া—এই চার দেশের মধ্যে পড়েছে। চারটি দেশই আফ্রিকা অঞ্চলের। টাঙ্গানিকা হ্রদটি ৩২ হাজার ৯০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গভীর হ্রদ। এর গভীরতা ১ হাজার ৪৭০ মিটার (৪ হাজার ৮২২ ফুট)। মিঠা পানির এই হ্রদটি আনুমানিক ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ বছরের পুরোনো।
এ হ্রদটি সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল ও রাশিয়ায় অবস্থিত। হ্রদটি আশ্চর্যজনক এক ভৌগোলিক নিদর্শন। ৩১ হাজার ৭২২ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত হ্রদটি। এটি বিশ্বের গভীরতম মিঠা পানির হ্রদ। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৬৪২ মিটার (৫ হাজার ৩৮৭ ফুট)। বৈকাল হ্রদ জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এখানে ১ হাজার ৭০০ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে। ঐতিহাসিকভাবে বুরিয়াটদের মতো স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কাছে হ্রদটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। বৈকাল হ্রদ প্রায় আড়াই কোটি বছরের পুরোনো। বিশ্বের প্রাচীন হ্রদগুলোর একটি এটি।
কানাডার নর্থওয়েস্ট টেরিটরিজ নামক ঠান্ডা ও দুর্গম অঞ্চলে এই হ্রদের অবস্থান। হ্রদটি ৩১ হাজার ৩২৮ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম হ্রদ। এ হ্রদ শুধু বিশালই নয়, এর গভীরতাও অনেক। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ৪৪৬ মিটার (১ হাজার ৪৬৩ ফুট)। জনবসতি থেকে দূরে হওয়ায় এই হ্রদটির ওপর মনুষ্য কার্যক্রমের প্রভাব কমই পড়েছে। আর এ কারণে এটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিষ্কার হ্রদগুলোর একটি। সেখানকার পানি এতটাই স্বচ্ছ যে সূর্যের আলো পানির খুব গভীরে পৌঁছাতে পারে। শীতের মাসগুলোতে গ্রেট বিয়ার হ্রদ বরফে আবৃত থাকে। এই বরফের পুরুত্ব ২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
এটি আফ্রিকান গ্রেট লেকস-এর অন্তর্গত একটি হ্রদ। প্রায় ২৯ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত হ্রদটি। আফ্রিকান রিফট সিস্টেমের অন্য যেকোনো হ্রদের তুলনায় এটিতে বেশি পানি আছে। হ্রদটি আনুমানিক ১০ থেকে ২০ লাখ বছরের পুরোনো। এটি অনেক গভীর একটি হ্রদ। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ৭০৬ মিটার (২ হাজার ৩১৬ ফুট)। এই হ্রদের তীরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের বসবাস। মূলত মাছ শিকারের ওপর ভিত্তি করে এখানকার স্থানীয় অর্থনীতি গড়ে উঠেছে।
গ্রেট স্লেভ হ্রদের নামকরণের ইতিহাসটি অবশ্য দুঃখজনক। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হ্রদটির দক্ষিণাঞ্চলীয় তীরে বসবাসকারী ক্রীতদাস শ্রেণির মানুষদের নিয়ে এই নামকরণ করা হয়েছে। গ্রেট স্লেভ হ্রদের অবস্থান কানাডার নর্থওয়েস্ট টেরিটরিজ অঞ্চলে। এটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ। আর উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের সবচেয়ে গভীর হ্রদ। হ্রদটির সর্বোচ্চ গভীরতা ৬১৪ মিটার (২ হাজার ফুট)। গ্রেট স্লেভ হ্রদটি প্রায় ২৮ হাজার ৫৬৮ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। কানাডার ম্যাকেঞ্জি নদীর প্রবাহের ক্ষেত্রে এই হ্রদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মাছ শিকারের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র এই হ্রদ। হ্রদের তীরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বসতি এলাকা আছে। এসব বসতি এলাকার বাসিন্দারা মিঠাপানির জন্য এই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। তীব্র ঠান্ডার কারণে হ্রদটি বছরের প্রায় আট মাসই আংশিকভাবে হিমায়িত থাকে।