শরিকদের সামলে কত দিন থাকতে পারবেন জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি
জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নেত্রী সানায়ে তাকাইচি। তবে তাঁর এই অর্জনের পথ মোটেও সহজ ছিল না। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন নিয়ে প্রকাশ্য ও অন্তরালের রাজনৈতিক দর–কষাকষি চলছিল।
পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট একবার স্থগিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত এলডিপি তৃতীয় বৃহত্তম দল নিপ্পন ইশিনের (জাপান ইনোভেশন পার্টি) সমর্থন পায়। সেই সমর্থনেই আজ মঙ্গলবার সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তাকাইচি জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ।
এর আগে এলডিপির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী কোমেই পার্টি কোয়ালিশন সরকার থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নতুন জোট সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ অবস্থায় প্রধান বিরোধী দল সাংবিধানিক গণতন্ত্রী পার্টি (সিডিপি) এবং নিপ্পন ইশিনসহ আরও কয়েকটি দল পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল, এদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠতে পারে। ফলে এলডিপির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তবে এলডিপিও নীরবে বসে থাকেনি।
রাজনৈতিক আলোচনায় শেষ পর্যন্ত নিপ্পন ইশিন কোন দিকে অবস্থান নেবে—তার দিকে জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গনের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এই দলের সমর্থন শেষ পর্যন্ত তাকাইচির নেতৃত্বে এলডিপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনল। নীতিগত অবস্থানের দিক থেকে দক্ষিণপন্থী হিসেবে পরিচিত নিপ্পন ইশিন অবশ্য তাদের লক্ষ্য ও নীতিমালার দিক থেকে বিরোধীদের চেয়ে এলডিপির অনেক কাছাকাছি। আলোচনা চলাকালে নিম্নকক্ষে ৩৫টি আসন থাকা নিপ্পন ইশিন হিসাব-নিকাশ করে এলডিপির সঙ্গে জোট গঠন করলে দলের বিভিন্ন দাবি আদায় করা সহজ হবে বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
নিপ্পন ইশিন দলের প্রধান কয়েকটি দাবির মধ্যে আছে—সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করে পশ্চিম জাপানের ওসাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু মন্ত্রণালয় সরিয়ে নেওয়া, দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করতে সমাজ বিমা প্রিমিয়ামের অর্থ পরিষদের সর্বনিম্ন স্তর বৃদ্ধি করা এবং খাদ্যসামগ্রীর ওপর থেকে ভোগ্যপণ্য কর তুলে নেওয়া।
এর আগে এলডিপি এসব বিষয়ের বিরোধিতা করে গেলেও ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে দলকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাকাইচির প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার দুয়ার খুলে গেছে।
তবে অনেকেই এখন যে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন তা হলো, কতটা স্থায়ী হতে পারবে জাপানের এই নতুন জোট সরকার। পার্লামেন্টের দুই কক্ষে তাকাইচি জিতলেও সংখ্যালঘু একটি সরকারের হাল তাকে ধরতে হচ্ছে। নিম্নকক্ষে এলডিপির মোট আসন হচ্ছে ১৯৬টি। এর সঙ্গে নিপ্পন ইশিনের ৩৫টি আসন যোগ হলে জোটের মোট আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ২৩১। যেটা ৪৬৫ আসনবিশিষ্ট নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন হওয়া ২৩৩টি আসনের চেয়ে দুটি কম।
প্রধানমন্ত্রীর ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাকাইচি নির্দলীয় ১১ পার্লামেন্ট সদস্যের মধ্যে কয়েকজনের ভোট পেলেও সে জন্য এলডিপিকে কী মূল্য দিতে হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। ফলে পার্লামেন্টে যেকোনো বিল পাস করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সেই একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি বারবার দেখা যেতে পারে।
এ ছাড়া বিশেষ করে বিমা প্রিমিয়াম এবং ভোগ্যপণ্য কর নিয়ে নিপ্পন ইশিনের সঙ্গে যে সমঝোতা এলডিপির হয়েছে, তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সরকারের আর্থিক অবস্থানের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। ফলে ইতিমধ্যে চাপের মধ্যে থাকা জাপানের অর্থনীতি সেসব পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেই প্রশ্ন নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
খাদ্যসামগ্রীর ওপর ভোগ্যপণ্য কর তুলে দেওয়ার মেয়াদ দুই বছর ধার্য করে নিপ্পন ইশিনকে রাজি করিয়েছে এলডিপি। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সরকারের আর্থিক অবস্থার ওপর চাপ বৃদ্ধি হলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা দুই দলের পক্ষ থেকে বলা হয়নি।
অন্যদিকে নিম্নকক্ষে ১৪৮টি আসন থাকা প্রধান বিরোধী সাংবিধানিক গণতন্ত্রী দলের পাশাপাশি ২৭টি আসন থাকা ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং আগের জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া কোমেই পার্টিও যে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে, তা সহজেই অনুমেয়। ফলে শুরু থেকেই অনেকটা ঝড়ের মুখে পড়তে হতে পারে তাকাইচির সরকারকে।
তাকাইচি ইতিমধ্যে তাঁর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রধান প্রধান পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন। নিপ্পন ইশিন মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মন্ত্রিসভা ভাগ-বাঁটোয়ারা করা তাকাইচির জন্য সহজ হয়েছে। দলের নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চারজনকেই তিনি মন্ত্রিসভায় রেখেছেন।
এঁদের মধ্যে তোশিমিৎসু মোতেগি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কোইজুমি শিনজিরো প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিনোরু কিহারা। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন সাৎসুকি কাতাইয়ামা। এখন দেখার বিষয়, সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনায় জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী কতটা দক্ষতা দেখাতে পারেন।