ভেনেজুয়েলায় মাদুরোকে সরানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কি এতটা সহজ হবে

ভেনেজুয়েলায় সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো ও তাঁর স্ত্রী সিলিয়া ফ্লোরেস। ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, লা গুয়াইরাছবি: রয়টার্স

ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন আর কেবল কূটনৈতিক টানাপোড়েন নয়; এটি কার্যত এক দীর্ঘস্থায়ী ‘যুদ্ধাবস্থায়’ রূপ নিয়েছে। সামরিক সংঘর্ষ সরাসরি শুরু না হলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, তেলবাণিজ্যে অবরোধ, সমুদ্রপথে নজরদারি ও নৌযানে হামলা এবং রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যুদ্ধকালীন উত্তেজনার কাছাকাছি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই উত্তেজনা আবারও বেড়েছে, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।

এই সংঘাতের কেন্দ্রে আছেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—ষাটোর্ধ্ব মাদুরো ক্ষমতা ছাড়লে কি ভেনেজুয়েলার সব সমস্যার সমাধান হবে? নাকি তাঁর বিদায় আরও বড় অস্থিরতার পথ খুলে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর সরল নয়, কারণ সংকটটি কেবল একজন শাসকের নয়; এটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জটিল সমীকরণ।

সংকটের উৎস: রাজনীতি থেকে ভূরাজনীতি

ভেনেজুয়েলার বর্তমান সংকটের শিকড় খুঁজতে গেলে হুগো চাভেজ-পরবর্তী রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা, দেশটির তেলের ওপর অতিনির্ভরশীল অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরিতার কথা বলতে হয়। ২০১৩ সালে চাভেজের মৃত্যুর পর মাদুরো ক্ষমতায় আসেন। এরপর থেকেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া, বিরোধী দল দমন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ—এই তিন অভিযোগ তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে উঠতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই মাদুরোর সরকারকে অবৈধ বলে দাবি করে আসছে। ২০১৯ সালে বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া সেই দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তোলে। যদিও গুয়াইদোকে নিয়ে তৈরি সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়, তবু সে সময় থেকে বিশেষ করে তেল খাতকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হয়।

‘যুদ্ধাবস্থা’ কেন বলা হচ্ছে

বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এপির প্রতিবেদন মতে, এই পরিস্থিতিকে অনেক বিশ্লেষক ‘যুদ্ধাবস্থা’ বলছেন মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি কার্যত অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ও নজরদারি বেড়েছে। তৃতীয়ত, মাদুরো সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে।

যুদ্ধ এখানে সরাসরি বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে নয়; বরং অর্থনীতি ও কূটনীতির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা একে ‘হাইব্রিড কনফ্লিক্ট’ বলছেন, যেখানে নিষেধাজ্ঞা নিজেই একটি অস্ত্র।

বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক ও সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি জেরাল্ড ফোর্ড
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সরকার না জনগণ

যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হলো—নিষেধাজ্ঞা মাদুরো সরকারকে দুর্বল করবে। কিন্তু বাস্তবে এর বড় ধাক্কা গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ভেনেজুয়েলায় খাদ্যসংকট, ওষুধের অভাব ও মুদ্রাস্ফীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

এই মানবিক সংকট আবার মাদুরোর জন্য রাজনৈতিক হাতিয়ারও হয়েছে। তিনি বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’-এর জন্য দায়ী করে জাতীয়তাবাদী আবেগ উজ্জিবিত করতে পারছেন। ফলে নিষেধাজ্ঞা একদিকে সরকারকে চাপে ফেললেও, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে শাসন টিকিয়ে রাখার শক্তিও জুগিয়েছে।

মাদুরো ক্ষমতা ছাড়লে কী হবে

অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারকের ধারণা—মাদুরো ক্ষমতা ছাড়লেই ভেনেজুয়েলা স্বাভাবিক পথে ফিরবে। কিন্তু বাস্তবতা এতটা সহজ নয়। কারণ, মাদুরোর শাসনব্যবস্থা কেবল একজন ব্যক্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি—সবখানেই তাঁর অনুগতদের শক্ত অবস্থান রয়েছে।

মাদুরো হঠাৎ সরে গেলে একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হবে। সেই শূন্যতা কে পূরণ করবে—এটাই বড় প্রশ্ন। বিরোধী দল বিভক্ত, সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনিশ্চিত, আর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থ পরস্পরবিরোধী।

ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো (ডানে) কারাকাসে সামরিক মহড়া চলার সময় ক্ষেপণাস্ত্র হাতে অনুশীলনকারী এক সেনাসদস্যকে পর্যবেক্ষণ করছেন
এএফপি ফাইল ছবি

সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি

যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কথা প্রকাশ্যে না বললেও, সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতে ইরাক ও লিবিয়ার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—একজন শাসককে সরিয়ে দিলেই স্থিতিশীলতা আসে না। বরং রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।

ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বেশি। কারণ, দেশটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠী, সীমান্ত অপরাধচক্র এবং রাজনৈতিক মিলিশিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপ হলে তা দ্রুত গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে—যার প্রভাব পুরো লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে।

রাশিয়া, চীন ও কিউবার ভূমিকা

ভেনেজুয়েলা সংকটকে কেবল যুক্তরাষ্ট্র বনাম মাদুরো হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এখানে রাশিয়া, চীন ও কিউবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদন মতে, ভেনেজুয়েলাকে রাশিয়া সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে, চীন বিপুল ঋণ ও বিনিয়োগ করেছে, আর কিউবা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহায়তার মাধ্যমে মাদুরো সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

মাদুরো ক্ষমতা হারালে এই শক্তিগুলোর স্বার্থও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ফলে তারা সহজে পিছু হটবে—এমনটা ধরে নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। এই বহুপক্ষীয় জটিলতাই সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আঞ্চলিক প্রভাব ও উদ্বাস্তু সংকট

ভেনেজুয়েলার অস্থিরতা ইতিমধ্যে কলম্বিয়া, ব্রাজিল ও পেরুকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলেছে। লাখ লাখ উদ্বাস্তু এসব দেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এটি লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম বড় মানবিক সংকট।

যুদ্ধ বা হঠাৎ শাসনপরিবর্তন হলে এই স্রোত আরও বাড়বে। ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাও এখন আন্তর্জাতিক সমাজের বড় চ্যালেঞ্জ।

তাহলে পথ কী? অনেক বিশ্লেষকের মতে, একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হলো রাজনৈতিক সমঝোতা। অর্থাৎ, মাদুরো সরকারের সঙ্গে বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের আলোচনার মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় যাওয়া। এর সঙ্গে ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা যেতে পারে।

কিন্তু এই সমঝোতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি। যুক্তরাষ্ট্র ও বিরোধী দল মাদুরোকে বিশ্বাস করে না। আর মাদুরো বিশ্বাস করেন না যে ক্ষমতা ছাড়লে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা নিরাপদ থাকবেন।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এপি, আল-জাজিরা