দ্রুত ফুরিয়ে আসছে রিজার্ভ, কীভাবে টিকবে বলিভিয়া
কয়েক সপ্তাহ ধরে বলিভিয়ায় অভূতপূর্ব কিছু ঘটনা ঘটছে। গত মাস থেকেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি জনগণের কাছে ডলার বিক্রি শুরু করেছে। মুদ্রা বিনিময় প্রতিষ্ঠানগুলো কপর্দকশূন্য হয়ে যাওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ডলার কিনতে রাজধানীর ব্যাংকে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। অনেক সময় এই সারি রাজপথে নেমে আসছে।
বলিভিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন কত, সেই তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ থেকে ধারণা করা যায়, সরকারের কাছে খুব বেশি রিজার্ভ আর অবশিষ্ট নেই। দেশটি থেকে বিনিয়োগকারীরা চলে যেতে শুরু করেছেন। ফলে সরকারি বন্ডের দাম পড়ে যাচ্ছে। আগামী ২০২৮ সালের সরকারি বন্ড এখন ১ ডলারের পরিবর্তে ৪৮ সেন্ট দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
বলিভিয়ার বর্তমান এই পরিস্থিতি তাদের বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি সমস্যাকে প্রতিফলিত করছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই তাদের এ পরিস্থিতির পেছনে কিছুটা দায়ী করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে সুদের হার বৃদ্ধি ও জ্বালানির উচ্চ মূল্যকে। এসব কারণে দেশটির ঋণ নেওয়া আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। তবে এর বাইরে দেশটির অর্থনৈতিক দুর্দশার পেছনে আরেকটি বড় কারণ রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে, তাদের বেপরোয়া অর্থনৈতিক মডেল।
বলিভিয়ায় এই সংকটের শুরু হয়েছে প্রায় দুই দশক আগে। দেশটির বামপন্থী জনতুষ্টিবাদী নেতারা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে সংকট বাড়তে শুরু করেছে। ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ইভো মোরালেস শপথ নেওয়ার পর থেকে ঔপনিবেশিক ও নব্য উদারবাদী যুগের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু বর্তমানে তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক জনতুষ্টিবাদের ফল স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। লাতিন আমেরিকার যেসব দেশ বলিভিয়াকে রোল মডেল মনে করেছিল, এখন তাদের এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে।
প্রথম শিক্ষাটি হতে পারে, কোনো পণ্যের বাড়বাড়ন্ত অবস্থাকে অতি মূল্যায়ন না করা। মোরালেস যখন ক্ষমতায় বসেন, তখনই তিনি যেন হাতে জ্যাকপট পেয়ে যান। ওই সময় গ্যাসের দাম ছিল বাড়তি। দেশটির পালে ওই সময় হাওয়া লাগে। কারণ, এখন পর্যন্ত গ্যাসের বৈশ্বিক চাহিদার দশমিক ৪ শতাংশ সরবরাহ করে বলিভিয়া। ওই সময় গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানি ব্যাপক বেড়ে যায়। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমা হয়।
২০০৩ সালে যেখানে বলিভিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১২ শতাংশ ছিল, তা ২০১২ সালে ৫২ শতাংশে পৌঁছায়। ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী লুই আর্ক ও মোরালেস মিলে অযৌক্তিক ব্যয় বাড়াতে শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল জ্বালানিতে ভর্তুকির মতো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাদের সুদিন খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। গ্যাসের দাম ও উৎপাদন কমতে থাকে। বলিভিয়ার আয়ের উৎসও শুকাতে শুরু করে।
বলিভিয়া থেকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো আরেকটি বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারে। আর তা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেঁধে দেওয়ার বিষয়টিতে কট্টর অবস্থান। লাতিন আমেরিকাকে ‘কারেন্সি পেজ’ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে ইকনোমিস্ট। কারেন্সি পেজ হচ্ছে একটি নীতি, যেখানে জাতীয় সরকার মুদ্রার জন্য একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
২০০৮ সালে বলিভিয়া সরকার বিদেশি মুদ্রার নির্দিষ্ট বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। ২০১১ সাল থেকে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৯৬ বলিভিয়ানো ডলার। মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক করে দেওয়ায় কিছুদিন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতি ঠিক থাকলেও পরে অশান্তির বাতাস বইতে শুরু করে। সময়ের ব্যবধানে মুদ্রার বিনিময় হার বেঁধে দেওয়ার মূল্য চুকাতে হয় মোরালেস সরকারকে। স্থিতিশীলতা আনার বদলে তৈরি করে নানা সমস্যা।
বলিভিয়া থেকে লাতিন আমেরিকা আরেকটি বিষয় শিখতে পারে। আর তা হলো, ব্যক্তিগত পুঁজির প্রতি বৈরিতা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। বলিভিয়া একসময় গণহারে জাতীয়করণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে দেশটির গ্যাসক্ষেত্র ও বৈদ্যুতিক গ্রিড সরকার জাতীয়করণ করে নেয়। সরকার অন্যান্য ব্যবসাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করে। ফলে দেশটিতে বিনিয়োগ সংকুচিত হতে শুরু করে।
বলিভিয়ায় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ১৯৯৯ সালে যেখানে জিডিপিতে ১২ শতাংশ ভূমিকা রাখত, সেখানে গত পাঁচ বছরে দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বলিভিয়ায় সবচেয়ে কম বিনিয়োগ হচ্ছে। সেখানে বড় কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানিও নেই।
বর্তমানে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ইভো মোরালেস আমলের অর্থমন্ত্রী লুই আর্ক। উদ্যোক্তাদের আকর্ষণে তাঁর সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। তিনি যথেষ্ট দেরিও করে ফেলেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন দেখাতে বা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে, বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ ছাড়া ঋণখেলাপি হয়ে যেতে পারে। এর বিকল্প হিসেবে চীনের কাছে লিথিয়াম খনিগুলো বিক্রি করে দিতে পারে।
বলিভিয়ার মতোই লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রেখেছে। অনেক দেশ আবার তাদের দেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন এ অঞ্চলে নতুন করে ‘গোলাপি জোয়ার’ শুরু হয়েছে। বামপন্থী সরকার বেড়ে যাওয়াকে গোলাপি জোয়ার বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য তাদের প্রবৃত্তিকে কতটা প্রশ্রয় দিতে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক করছে তারা। অর্থ ফুরাতে থাকা বলিভিয়া থেকে তাদের জন্য বার্তা হচ্ছে, কোথায় থামতে হবে, তা জানা জরুরি।