ডোমিনিকান একনায়ক ট্রুজিলোকে হত্যার পর গাড়িতে মরদেহ নিয়ে যায় বন্দুকধারীরা

ডোমিনিকান রিপাবলিকের সেনাশাসক রাফায়েল ট্রুজিলো
ছবি: দেশটির ন্যাশনাল আর্কাইভের সৌজন্যে

রাফায়েল লিওনিদাস ট্রুজিলো মোলিনা। তবে রাফায়েল ট্রুজিলো নামেই তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। ১৯৩০ সাল থেকে ক্যারিবিয়ান দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিককে তিন দশক শাসন করেছেন শক্ত হাতে। ট্রুজিলো ছিলেন নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া শাসক। এই একনায়ককে দেখা হয় লাতিন আমেরিকার সামরিক একনায়কদের প্রতিভূ হিসেবে।
কুখ্যাত এই একনায়কের পতনও হয়েছিল অত্যন্ত নির্মমভাবে। ১৯৬১ সালের ৩০ মে ট্রুজিলোর গাড়ির পিছু নিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে চার আততায়ী। জানা যায়, পুরো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাতজন। ট্রুজিলোকে হত্যার পর তাঁর লাশও লুকিয়ে রেখেছিল হত্যাকারীরা।

যেভাবে উত্থান

অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার অভিযোগে ১৯১৬ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিক দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাশনাল গার্ড নামে একটি বাহিনী গঠন করে দেশটি। মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সেনাদের একজন ছিলেন ট্রুজিলো। সাহসী মানসিকতার ট্রুজিলো ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে জায়গা করে নেন। একপর্যায়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেন।

সাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে ১৯২৪ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন হোরাসিও ভাসকেজ। তাঁর উদারবাদী সরকার মুক্তবাণিজ্যের নীতি গ্রহণ করে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে চিনি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ট্রুজিলোর ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসনামলের একটি চিত্র পাওয়া যায় ‘দ্য ডিক্টেটর’স সেডাকশন: পলিটিকস অ্যান্ড পপুলার ইমাজিনেশন ইন দ্য ইরা অব ট্রুজিলো (২০১০)’ বইয়ে। বইটির লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক লরেন ডার্বি।

বইটিতে বলা হয়, মহামন্দার সময় ডোমিনিকান রিপাবলিকের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এ জন্য উদারবাদী সরকারের নেওয়া নীতিকে একটি বিপর্যয়কর ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে সুরক্ষামূলক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মার্কিন সেনা ও হাইতির অভিবাসীদের থেকে সীমান্ত সুরক্ষার পক্ষে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা শক্তিশালী হতে থাকে। শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৩০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভাসকেজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সেনাপ্রধান ট্রুজিলো। তিনি ক্ষমতা দখল করে জনতুষ্টিবাদী নীতি গ্রহণ করেন।

সামরিক একনায়কের দৃষ্টান্ত

ট্রুজিলোর শাসনামলে দেশটিতে কোনো কার্যকর বিরোধী দল ছিল না। ছিল না বাক্‌স্বাধীনতা কিংবা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। বিরোধীদের নিপীড়ন করা হতো সন্ত্রাসী কায়দায়। কেউ যদি তাঁর বিরোধিতা করতেন, তাঁকে কারাগারে পাঠানো হতো, নির্যাতন করা হতো, এমনকি হত্যা করা হতো। তাঁদের লাশও গুম করে ফেলা হতো। ‍গুঞ্জন ছিল, সেসব মরদেহ হাঙরকে খাওয়ানো হতো।

নিজের শাসনামলে ট্রুজিলো বিভিন্ন পদক ও খেতাব সংগ্রহ করেন। নিজের এবং পরিবারের জন্য সম্পদ কুক্ষিগত করেন। তিনি রাজধানীর নাম পাল্টে সিউদাদ ট্রুজিলো রাখেন। দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নামকরণ করেন পিকো ট্রুজিলো নামে।

জেনারেল ট্রুজিলোকে তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে অনেকেই লাতিন আমেরিকার সামরিক একনায়কের প্রধান দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করেছিলেন। শুধু দেশের ভেতর নিষ্ঠুর শাসনই নয়, প্রতিবেশী ক্যারিবীয় দেশগুলোর সঙ্গেও প্রায়শই বিরোধে জড়ান তিনি। ট্রুজিলোর অভিযোগ ছিল, ডোমিনিকান রিপাবলিকের নির্বাসিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাঁর সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এসব দেশ।

অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অজুহাত দেখিয়ে ১৯৩৭ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিকের সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে হাইতিতে ঢুকে পড়ে। তারা হাইতির ১০ থেকে ১৫ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। কেউ কেউ নিহতের এই সংখ্যা ২০ হাজার বলে দাবি করে আসছেন। অথচ হাইতির এসব নাগরিক সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করে আসছিল। এমনকি ট্রুজিলোর মা ছিলেন হাইতি বংশোদ্ভূত।

কিউবায় নির্বাসিত ডোমিনিকান নাগরিকদের নেতৃত্বে ট্রুজিলোর সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ১৯৪৯ সালে ওই বিদ্রোহ কঠিনভাবে দমন করে ডোমিনিকান সেনাবাহিনী। এ ছাড়া ট্রুজিলোবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ায় কয়েকজন ডোমিনিকান নাগরিক নিউইয়র্কে গুপ্তহত্যার শিকার হন।

যেভাবে ট্রুজিলোকে হত্যা করা হয়

১৯৬১ সালের ৩০ মে রাত ১০টার কিছুক্ষণ আগে একটি বিলাসবহুল লিমুজিন উপকূলীয় সড়ক ধরে রাজধানী সান্তো দোমিঙ্গো থেকে সান ক্রিস্তোবাল শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন সড়কটি ছিল অনেকটাই নিস্তব্ধ। চালক ছাড়া ওই গাড়ির একমাত্র যাত্রী ছিলেন সেনাশাসক ট্রুজিলো।

একটি ১৯৫৮ মডেলের শেভ্রোলে গাড়ি আড়াল থেকে বের হয়ে দুই মাইল ওই লিমুজিনটিকে অনুসরণ করে। গাড়িটিতে ছিল চার বন্দুকধারী। হঠাৎ করে বন্দুকধারীদের গাড়িটি ট্রুজিলোর গাড়ির পাশাপাশি চলে আসে এবং তারা গুলি করতে শুরু করে। লিমুজিনের চালক ব্রেক করলে বন্দুকধারীদের গাড়িটি ঝাঁকুনি খেয়ে ২০ ফুট দূরে গিয়ে থামে।

শেভ্রোলে গাড়িটির চালক ছিলেন আন্তোনিও ইমবার্ত। ওই সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। ২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রুজিলোকে হত্যার বর্ণনা দেন তিনি। আন্তোনিও বলেন, ট্রুজিলো ও তাঁর গাড়িচালকও পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করেন।

ট্রুজিলোকে হত্যাকারী চার বন্দুকধারীর একজন আন্তোনিও ইমবার্ত
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

কীভাবে তিনি এবং অন্য বন্দুকধারীরা গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন এবং সামনে এগিয়ে যান, সে বর্ণনাও দেন আন্তোনিও। তিনি বলেন, ‘আহত হলেও ট্রুজিলো তখন হাঁটছিলেন। ফলে আমি তাঁকে আবার গুলি করি।’

ট্রুজিলোকে সাধারণত ‘এল হেফে (প্রধান বা বস)’ হিসেবে ডাকা হতো। বন্দুকযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মহাসড়কের ওপর পড়ে ছিল তাঁর নিথর দেহ। আন্তোনিও বলেন, ‘এরপর আমরা তাঁর মরদেহ গাড়িতে তুলে নিয়ে যাই।’ এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত একজনের বাসায় মরদেহটি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেখান থেকে ট্রুজিলোর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ট্রুজিলোকে হত্যার পর পালিয়ে ছিলেন আন্তোনিও এবং তাঁর সঙ্গীরা। দুই বছর পর ট্রুজিলোর উত্তরসূরি ক্ষমতাচ্যুত হলে প্রকাশ্যে আসেন তাঁরা। আন্তোনিওকে সামরিক বাহিনীর সম্মানজনক পদ দেওয়া হয়। জেনারেল আন্তোনিও ইমবার্ত হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। ১৯৬৫ সালের সেনাশাসনের সময় তিনি কিছুদিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন।

আরও পড়ুন

নেপথ্যে সিআইএর হাত

নিজের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন ট্রুজিলো। একটি ছবিতে ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে আলিঙ্গন করতে দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল ট্রুজিলোকে। তবে মানবাধিকার বিষয়ে ট্রুজিলোর সঙ্গে ক্রমেই সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের। বিশেষ করে ট্রুজিলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট রোমুলো বেটানকোর্টকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র ডোমিনিকান রিপাবলিকে তাঁদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়।

প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার উপযুক্ত উত্তরসূরি পাওয়া গেলে ট্রুজিলোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদনও করেছিলেন। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের কারণে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেওয়া থেকে শেষ মুহূর্তে সরে আসে নতুন কেনেডি প্রশাসন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, এতে দেশটিতে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো নেতার উত্থান হতে পারে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার দায়িত্বে থাকা হাউস উপকমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জেমস স্ট্যানটন কমিটির এক শুনানিতে ‘সফল গুপ্তহত্যা’ চেষ্টার কথা বলেন, যেখানে সিআইএ যুক্ত ছিল। ঘটনাটি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এই গুপ্তহত্যা বলতে ট্রুজিলোকে হত্যার বিষয়টিই বোঝানো হয়েছিল।

সিআইএর এমন মনোভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ১৯৬০ সালে লেখা গোয়েন্দা সংস্থাটির এক কর্মকর্তার চিঠিতেও। ডোমিনিকান রিপাবলিকে দায়িত্বরত সিআইএর অঘোষিত স্টেশনপ্রধান হেনরি ডিয়ারবর্ন লিখেছিলেন, ‘আমি যদি একজন ডোমিনিকান হতাম, তাহলে আমার দেশকে মুক্ত করতে প্রথম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ট্রুজিলোকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে থাকতাম। এমনকি একজন খ্রিষ্টান হিসেবে আমি এটাকে কর্তব্য বলে মনে করব।’

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক ট্রুজিলোকে গুপ্তহত্যায় ‘সরঞ্জাম’ দিয়ে সাহায্য করেছিল সিআইএ। এ হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরে সিনেট কমিটিতে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থাটি।

তথ্য সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমসবিবিসি