লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহারে আর্জেন্টিনার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনেস এইরেসের বিদ্যালয়গুলোতে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। শহর কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে চলা লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা বিতর্কের পালে নতুন করে হাওয়া দিয়েছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের

স্পেনের সাবেক উপনিবেশ আর্জেন্টিনার দাপ্তরিক ভাষা স্প্যানিশ। কিছু স্প্যানিশ ভাষাভাষীকে এই ভাষার ‘আমিগোস’ (ছেলে বন্ধুরা) শব্দের জায়গায় ‘আমিগেস’ ব্যবহার করতে দেখা যায়। আবার ‘সব’ বোঝাতে ‘তদোস’–এর জায়গায় তোদেকিসেসে লেখা হচ্ছে।

বুয়েনেস এইরেসের বিদ্যালয়গুলোতে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই পরিবর্তন চালু হয়েছে। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হলো যাতে ভাষার মাধ্যমে পুরুষ নাকি নারী, তা চিহ্নিত করা না যায়। যেখানে ভাষার অনেক শব্দই পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গে ভাগ করা আছে।

লিঙ্গনিরপেক্ষ এই ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা লাতিন আমেরিকাজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে। ইংরেজি ও ফরাসিসহ অন্যান্য ভাষাতেও এমন ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এই উদ্যোগের সমর্থকদের মতে, এতে সমাজ আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।

তবে অনেক শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিকসহ স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের একটি অংশের মতে, এই পরিবর্তন ৫০ কোটি মানুষের এই ভাষার মানের অবনমন ঘটাবে।

আর্জেন্টিনায় এই বিতর্ক জনমত যুদ্ধ থেকে এখন নীতিগত লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।

গত মাসে রাজধানী বুয়েনেস এইরেস কর্তৃপক্ষ শ্রেণিকক্ষে এবং অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপে শিক্ষকদের কোনো ধরনের লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বুয়েনেস এইরেসের শিক্ষামন্ত্রী সোলেদাদ আকুইনা বলেছেন, এ ধরনের ভাষা স্প্যানিশ ভাষার নিয়মবিরোধী এবং শিক্ষার্থীদের বোধগম্যের জন্য সহায়ক নয়।

কর্তৃপক্ষের নতুন নিয়মকে নিষেধাজ্ঞা বলতে নারাজ আকুইনা। তিনি বলেন, ‘ভাষা নিজে থেকেই বেশি কিংবা কম অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। এটা নির্ভর করে মানুষ কীভাবে তা ব্যবহার করছে।’

এই প্রথম কোথাও লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। বুয়েনেস এইরেসের এই নীতি তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে। আর্জেন্টিনার শিক্ষামন্ত্রী হাইমে পেরসিক এই নিয়মের সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি সমকামী ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনসহ কমপক্ষে পাঁচটি সংস্থা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে আদালতে আবেদন করেছে।

শিক্ষামন্ত্রী পেরসিক এই নিয়মকে স্পেনে ফ্যাসিবাদী একনায়ক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর আমলে বাঁ-হাতে লেখা নিষিদ্ধ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারা (বুয়েনেস এইরেস কর্তৃপক্ষ) মনে করছে, তারা ভুল কিছু সংশোধন করছে, কিন্তু এর প্রভাব অনেক গভীর।’ তাঁর ব্যাখ্যায়, আর্জেন্টিনার সংস্কৃতিতে প্রচলিত যৌনতাবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শিক্ষার্থীরা লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করছে।

স্প্যানিশ, ফরাসি, ইতালীয় ও পর্তুগিজসহ রোমাঞ্চ (লাতিন) ভাষাগুলোর লিঙ্গনিরপেক্ষ পরিভাষা বিশেষ করে ব্যাপক বিতর্কের বিষয় হতে পারে। কারণ, এসব ভাষার ব্যাকরণের পুরোটাই লিঙ্গভিত্তিক।

বলা হচ্ছে, ভাষাগত বিশুদ্ধতাবাদীদের কলঙ্কিত করেছে লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা। স্পেনের রয়্যাল একাডেমিকে অনেকেই স্প্যানিশ ভাষার দ্বাররক্ষী হিসেবে মনে করেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছে, লিঙ্গনিরপেক্ষ করতে গিয়ে শব্দে যেসব অক্ষরের পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা স্প্যানিশ ভাষার রূপতত্ত্বে নেই।

গত বছর ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এবং বিদ্যালয়গুলোতে অন্তর্ভুক্তিমূলক লেখা (লিঙ্গনিরপেক্ষ) এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। গত অক্টোবরে ফ্রান্সের একটি স্বনামধন্য অভিধানে একবচনের সর্বনামের ক্ষেত্রে লিঙ্গনিরপেক্ষ ‘ইয়েল (আইইএল)’ ব্যবহার করলে তা তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়।

এই বিতর্ক লাতিন আমেরিকার উদীয়মান সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে ‘স্প্যানিশ ভাষার নিয়মের সঙ্গে সংগতি ধরে রাখতে’ উরুগুয়ের সরকারি শিক্ষা সংস্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক (লিঙ্গনিরপেক্ষ) ভাষার ব্যবহার সীমিত করে একটি স্মারক জারি করে।

পেরু, মেক্সিকোর কিছু প্রদেশে এবং ব্রাজিলের অন্তত ৩৪টি পৌরসভা ও প্রদেশের বিদ্যালয় কিংবা সরকারি কাগজপত্রে লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অক্টোবরে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এই নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়ছেন জইর বোলসোনারো। ডিসেম্বরে শিক্ষাবিষয়ক এক আলোচনায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমকামীদের লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা আমাদের বাচ্চাদের বিভ্রান্ত করছে।’

কলম্বিয়ার সদ্য নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিয়া মার্কেজ নির্বাচনী প্রচারণায় লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করে রক্ষণশীলদের তোপের মুখে পড়েন। ডানপন্থী আইনপ্রণেতা মার্গারিতা রেস্ত্রেপো টুইটারে লিখেছেন, ‘ঈশ্বর, কলম্বিয়াকে রক্ষা করো।’

যুক্তরাষ্ট্রেও লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা বিতর্ক চলছে। বহুল ব্যবহৃত একটি অভিধান ২০১৮ সালে ‘লাতিনক্স’ শব্দটি যুক্ত করে। তবে ২০১৯ সালে করা পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ অনুযায়ী, এমনকি হিস্পানিকদের অনেকেই এই শব্দ শোনেননি। কলেজপড়ুয়া কিছু তরুণী মূলত শব্দটি ব্যবহার করেন।

লাতিন অঞ্চলের ভাষাগুলোতে এই পরিবর্তনের চেষ্টা ১৯৭০ এর দশকে নারীবাদীদের থেকে শুরু হয়। তারা এসব ভাষার ব্যাকরণের পুংলিঙ্গ ব্যবহারের একটি নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করেন। ওই নিয়ম অনুযায়ী, কোনো একটি দলে মাত্র একজন পুরুষ থাকলেও পুংলিঙ্গ ব্যবহার করতে হয়। সেই আন্দোলনের পথ ধরেই এখন বিশ্বজুড়ে লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা বিতর্ক জোরেশোরে সামনে আসছে।

কেউ কেউ বলছেন, লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা নেই। এ ধরনের ভাষা নিষিদ্ধের বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কিছু অভিভাবক ও শিক্ষক। বুয়েনেস এইরেসের পালের্মোর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ভানিনা এম কাসালি বলেন, ‘এমনকি লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষাও অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। আমাদের বিদ্যালয়ে শেখন-জটিলতায় এখন শিক্ষার্থীরা। এ ধরনের ভাষা শেখা তাদের জন্য আরও কঠিন হচ্ছে।’

তবে একটি কমিউনিটি সেন্টারের ‘আফটার-স্কুল’ স্বেচ্ছাসেবী আলেক্সান্দ্রা রদ্রিগেজ বলেন, ‘ইতিমধ্যে চালু হয়ে যাওয়া একটি বিষয় আপনি দমিয়ে রাখতে পারেন না। ভাষা এমন একটি জিনিস, যা সব সময় পরিমার্জিত হয়। আমরা বেঁচে আছি বলে এটা বেঁচে আছে এবং এটি পরিবর্তিত হতে থাকবে।’