ব্রাজিলে পুলিশের প্রাণঘাতী অভিযানের ভয়াবহতার কিছুটা ধরা পড়ল ছবিতে
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর সবচেয়ে পুরোনো গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযানে মঙ্গলবার রাতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪। তাঁদের মরদেহ শহরের মর্গে রাখা হয়েছে। মাদকবিরোধী এ অভিযানকে ব্রাজিলের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী অভিযান হিসেবে ধরা হচ্ছে।
তবে বুধবার ভোরের আলো ফোটার পর বোঝা গেল, হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত ভয়াবহতা।
রয়টার্সের আলোকচিত্রী রিকার্দো মোরায়েসের ড্রোনে তোলা ছবিগুলো দেখে শুরুতে হয়তো বুঝতে একটু কষ্ট হতে পারে, এগুলো কিসের ছবি। ছবিতে দেখা যায়, বাড়ির ছাদ, ব্যস্ত রাস্তা, আর রাস্তার মাঝবরাবর কিছু একটা বয়ে গেছে।
তবে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ওগুলো কয়েক ডজন মানুষের মরদেহ। কারও দেহ চাদরে ঢাকা, আবার কারও দেহ অর্ধনগ্ন ও অনাবৃত অবস্থায় পড়ে আছে। মরদেহগুলো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, পড়ে আছে একটি বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায়।
গত মঙ্গলবার পুলিশি অভিযানের পর রিও ডি জেনিরোর পেনহা এলাকার বাসিন্দারা সারা রাত ধরে নিখোঁজ স্বজন ও প্রতিবেশীদের খুঁজে বেড়ান। একপর্যায়ে তাঁরা তাঁদের বাড়িঘর থেকে উঁচু এলাকায় পাহাড়ি বনের মধ্যে একের পর এক মরদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন।
পরে নাগরিক অনুসন্ধানকারী দলগুলো সেসব মরদেহ পিকআপ ভ্যানে তুলে ভিলা ক্রুজেইরো ফাভেলার প্রবেশদ্বারে নামাতে শুরু করে। রিও ডি জেনিরোর পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে থাকা শত শত দরিদ্র ও অনানুষ্ঠানিক বসতির একটি এই ভিলা ক্রুজেইরো ফাভেলা।
গত বুধবার সকালে আলোকচিত্রী মোরায়েস সেখানে পৌঁছান। তিনি দেখেন, যে রাস্তায় প্রতিদিন মানুষ কেনাকাটা করে এবং বাচ্চারা ফুটবল খেলে, সেখানে পড়ে আছে সারি সারি মরদেহ।
রাস্তার এক পাশে শোকার্ত পরিবার, অন্য পাশে হতভম্ব প্রতিবেশীরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
এক নারী চিৎকার করে এগিয়ে এসে বড় একটি ত্রিপল টেনে সরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, প্রায় অর্ধেক মরদেহে অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই। আর বাকি দেহগুলো রক্তমাখা বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা।
কাছ থেকে শোকাহত মানুষের কিছু ছবি তোলার পর মোরায়েস বুঝলেন, এই হত্যাযজ্ঞের পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়ার একমাত্র উপায় ড্রোন।
মোরায়েস আগে কখনো কোনো ফাভেলায় ড্রোন ওড়াননি। তিনি বলেন, সাধারণত এখানে ড্রোন ওড়ানো খুবই বিপজ্জনক। ড্রোনকে স্থানীয় মাদক চক্র আর পুলিশ—দুই পক্ষই হুমকি হিসেবে দেখে।
স্থানীয় একটির কমিউনিটির নেতার সঙ্গে কথা বলে মোরায়েস অনুমতি নেন, তারপর ড্রোন উড়তে শুরু করে।
মোরায়েস বলেন, ‘আমি সাধারণত ড্রোন ব্যবহার করতে পছন্দ করি না। তবে এই হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা দেখানোর জন্য ড্রোন ছাড়া আর কোনো ভালো উপায় ছিল না।
মাটি থেকে তোলা ছবিতে সামনের মরদেহগুলো স্পষ্টভাবে দেখা গেলেও মরদেহের সারি যত লম্বা হয়েছে, ততই সেগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে ড্রোন দিয়ে ওপর থেকে তোলা ছবিতে প্রতিটি দেহ, প্রতিটি জীবন সমানভাবে ধরা পড়েছে।
দিনের শেষে নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।
কর্তৃপক্ষ সড়কটির এক প্রান্ত থেকে যখন মরদেহ সরাতে শুরু করেছিল, অন্য প্রান্তে তখন পিকআপ ভ্যান এসে নতুন নতুন মরদেহ রেখে যাচ্ছিল।
মোরায়েস রিও ডি জেনিরোর পাহাড়ি বসতিগুলোয় দুই দশক ধরে সহিংসতা ঘটনার ছবি তোলেন। তিনি বলেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মরদেহের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। একসময় সংখ্যাটি ১০০ ছাড়িয়ে যায়।
রিওর গভর্নর ক্লাউদিও কাস্ত্রো অভিযানের পর বলেন, চারজন পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়া নিহতদের সবাই সন্দেহভাজন মাদক কারবারি। পুলিশের দাবি, কয়েক মাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ অভিযান চালানো হয়েছে। এতে অনেকে নিহত হবে বলে আগেই অনুমান করা হয়েছিল।
সড়কে তখন মরদেহ পচে গন্ধ ছড়াচ্ছিল। মোরায়েস বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। দিনের শেষে ফিরে এসে তিনি দেখেন, মরদেহগুলো সরানো হয়েছে। শ্রমিকেরা গন্ধ দূর করতে সড়কটি ধোয়ামোছার কাজ করছেন।