আর্জেন্টিনায় গর্ভপাত বৈধ, তবু বিপাকে নারীরা

আর্জেন্টিনা ২০২০ সালে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া নিয়ে একটি আইন পাস করেছে। কিন্তু এখনো নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে নারীদের।
ফাইল ছবি: এএফপি

মারিয়া (ছদ্মনাম) যখন গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর। তিনি যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন, সেখানে চিকিৎসক তাঁকে ইঙ্গিত করে সহকর্মীর সঙ্গে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। খুব বিব্রত হয়েছিলেন তিনি।

আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ সালতায় থাকেন মারিয়া। প্রদেশটি ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল। দেশটিতে গর্ভপাত আইনত হলেও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী এখনো এর বিরুদ্ধ মানসিকতা পোষণ করেন। এ কারণে নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে মারিয়ার মতো শত শত নারীকে।

শেষমেশ মারিয়াকে গর্ভাবস্থা কাটানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, নার্সরা তাঁর চিকিৎসা করাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। নিজেকে দোষী বোধ করাতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি গর্ভাবস্থার টিস্যু বের করে দেওয়ার পরে ভ্রূণ দেখতে পেয়েছি। আমি এটা দেখেছি কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নার্স তা একটি জারে রেখে আমাকে বলেছিলেন, “এটি আপনার সন্তান হতে পারত।”’

২০২০ সালে আর্জেন্টিনায় গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া নিয়ে একটি আইন পাস হয়েছে। দেশটিতে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি পাস হয়। এ আইনে গর্ভধারণের ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত ঘটানোর অধিকার পান স্থানীয় নারীরা। আগে দেশটিতে শুধু ধর্ষণের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে বা মাতৃত্বের কারণে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলে গর্ভপাত ঘটানোর অনুমতি ছিল।

দেশটিতে গর্ভপাত খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়। এ দেশে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি ক্যাথলিক ও ১৫ শতাংশ ইভাঞ্জেলিক খ্রিষ্টান। এ দুই পক্ষই গর্ভপাতের বিরোধিতা করে।

২০২১ সালে আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে গর্ভপাতের কারণে মৃত্যু হওয়া মায়েদের সংখ্যা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে গর্ভপাত করানো গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি বেড়েছে।
ভ্যালেরিয়া ইসলা, আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পরিচালক

আর আর্জেন্টিনার নতুন আইনেও স্বাস্থ্যকর্মীদের গর্ভপাত না করানোরও অনুমতি দেয়। সালতা এলাকার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বার্লোস ফ্রাঙ্কো বলেন, ‘আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি নিজেকে একজন বিবেকবান আপত্তিকারী হিসেবে ঘোষণা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, তাঁর ধারণা, প্রদেশের প্রধান সরকারি হাসপাতালের ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী একই কাজ করেছেন। ভ্রূণবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই তিনি বিশ্বাস করেন, সন্তান জন্মদানের মাধ্যমেই জীবন শুরু হয়।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো ভ্রূণের পর্যায় থেকে মানুষের জীবনের যত্ন নেওয়া ও তা রক্ষা করা।’

মারিয়া একজন চিকিৎসক দেখানোর জন্য প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দুই দিন অপেক্ষায় ছিলেন। এরপরও কোনো চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ করেন। এখানে তিনি মনিকা রদ্রিগেজ নামের স্থানীয় একজন অধিকারকর্মীর দেখা পান। মনিকা তাঁকে হাসপাতালে অভিযোগ দায়ের করতে এবং চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার নিশ্চিত করতে সহায়তা করেছিলেন।

দেশটিতে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মনিকা বলেন, তিনি সালতার নারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে এ ধরনের প্রায় ১০০টি ফোন কল পান। তাঁদের প্রায় সবার অভিযোগ, তাঁরা নিরাপদ গর্ভপাতের সুবিধা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, তাঁর প্রধান কাজ হলো সবার কথা শোনা। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ভপাত করানোর সুপারিশ করি না, আবার মাতৃত্বকে ফ্যাশন হিসেবেও দেখতে চাই না।’

আর্জেন্টিনায় গর্ভপাতের অধিকার সম্প্রসারণের প্রচার চালাতে কয়েক দশক সময় লেগেছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পরিচালক ভ্যালেরিয়া ইসলা বলেন, এ বিষয়ে এখন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে ভ্যালেরিয়া ইসলা বলেন, ২০২১ সালে আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে গর্ভপাতের কারণে মৃত্যু হওয়া মায়েদের সংখ্যা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে গর্ভপাত করানো গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া গর্ভপাত করানোর ওষুধ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে এবং তা ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে।

চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা ও গর্ভপাত নিয়ে সামাজিক বাধা নারীদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে দিচ্ছে। বিনা মূল্যে হওয়া উচিত—এমন চিকিৎসার জন্য নারীদের শত শত ডলার দিতে বাধ্য করানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।

২০২০ সালে আর্জেন্টিনায় গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া নিয়ে একটি আইন পাস হয়েছে। দেশটিতে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি পাস হয়।

দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা জুজুইর একটি পার্বত্য সম্প্রদায়ের সদস্য ও মনোবিজ্ঞানী মারিয়া লরা লার্মা বলেন, ‘এখানে মাফিয়া আছে। আর্জেন্টিনার অনেক গ্রামীণ এলাকায় কিছু চিকিৎসক আছেন, যাঁরা সরকারি হাসপাতালে কাজ করেও রোগীদের তাঁদের ব্যক্তিগত ক্লিনিকে নিয়ে যান।’

এসব কারণে সরকার নারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে গ্রাম এলাকার অনেক নারী এ অভিযোগ জানাতে এখনো ভয় পান। আবার যে চিকিৎসক গর্ভপাত করাতে রাজি হন, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা আইনি অভিযোগও করা হয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সালতায় ২১ বছর বয়সী একজন রোগীর খালার অভিযোগের ভিত্তিতে একজন চিকিৎসককে সাময়িক আটক করা হয়েছিল। ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অবৈধভাবে গর্ভপাত করেছিলেন। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল। এরপরও মামলাটি খারিজ করতে আদালতের এক বছর সময় লেগেছিল।

ক্যাথলিকস ফর দ্য রাইটস টু ডিসাইড নামে প্রো-চয়েজ ক্যাম্পেইন গ্রুপের আইনজীবী রোসিও গার্সিয়া গ্যারো বলেন, গর্ভপাতবিরোধী সংগঠনগুলোর বিচারক ও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক ভালো। তারা ভয় দেখিয়ে নারীদের গর্ভপাত করানো চিকিৎসকদের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেয়।

আরও পড়ুন

এদিকে গর্ভপাতবিরোধী প্রচারকারীরাও আদালতকে ব্যবহার করে গর্ভপাত আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সালতার স্থানীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি ক্রিস্টিনা ফিওরে তাঁদের একজন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের জীবন গর্ভধারণ থেকে শুরু হয়—আমরা এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।’ এসব কারণে এখন পর্যন্ত দেশে গর্ভপাত বিষয়ে সব ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জ ব্যর্থ হয়ে গেছে।

মারিয়া ইচ্ছা করেই সন্তান নিতে চাননি। এ কারণে তিনি গর্ভপাত করাতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি কখনোই মা হতে চাইনি...আমার বাবা-মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এ আঘাত কাটিয়ে উঠতে আমার কয়েক বছর লেগেছে।’

মারিয়া আরও বলেন, নার্স ও চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাঁর মতো গর্ভপাত করাতে গিয়ে অন্যদের এত কষ্ট না হয়। তিনি বলেন, ‘অনেক নারী আছেন, বিশেষ করে ছোট্ট গ্রামীণ শহরের নারীরা আমার মতো বৈষম্যের শিকার হন। আর তাঁরা এসব নিয়ে কথা বলার সাহসও পান না।’

আরও পড়ুন