ভেনেজুয়েলায় কি বড় সামরিক অভিযান চালাবেন ট্রাম্প

ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ক্যারিবীয় সাগরে মোতায়েন করা হয়েছে মার্কিন রণতরিছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি ক্যারিবীয় অঞ্চলে হাজার হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন করেছেন এবং ভেনেজুয়েলার ভূখণ্ডে হামলার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, ভেনেজুয়েলা ইস্যুতে ট্রাম্প ঠিক কত দূর যাবেন এবং এর ফলাফলই বা কী হতে পারে?

উদ্দেশ্য কী

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও সে যাত্রায় টিকে গিয়েছিলেন মাদুরো।

ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় বসার কয়েক দিন আগে মাদুরো তৃতীয়বারের মতো ছয় বছরের জন্য ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। যদিও গত বছর তাঁর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ভেনেজুয়েলায় সামরিক হামলার হুমকি দেওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প রাজনৈতিক কারণে এখন কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ছিল না। ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে সাধারণত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখেন না। বরং তিনি কূটনীতিকে দেওয়া-নেওয়ার নীতি হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ কীসের বিনিময়ে কী পাওয়া যাবে, তার ওপর ভিত্তি করে তিনি সম্পর্ক নির্ধারণ করেন। শুরুতে তিনি মাদুরোর ক্ষেত্রেও এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন।

তবে এ নীতিতে পরিবর্তন আনেন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের দেশ কিউবার কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে চান। যেহেতু ভেনেজুয়েলা থেকে কিউবা জ্বালানি তেলসহ নানা সুবিধা পায়, তাই রুবিও মনে করেন—মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা গেলে কিউবার সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে। মার্কো রুবিওর এই নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার কঠোর হুমকি দেওয়া শুরু হয়।

সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নিকোলা মাদুরোর বিষয়ে বলেন, ‘তাঁর দিন শেষ।’ সে সময় মাদুরোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে রাজি আছেন বলে জানালেও লাতিন আমেরিকার দেশটিতে তিনি মার্কিন সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি।

যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার অবৈধ মাদক উৎপাদন কেন্দ্রে অভিযান চালাতে পারে। দেশটিতে মাদকবিরোধী অভিযানের অজুহাত কাজে লাগিয়েই মূলত হামলায় হুমকি দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ভেনেজুয়েলায় এ ধরনের উৎপাদনকেন্দ্র খুব কম।

ছোটখাটো সামরিক অভিযানের আশঙ্কা কতটুকু

বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেনেজুয়েলায় সামরিক হামলার হুমকি দেওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প রাজনৈতিক কারণে এখন কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভেনেজুয়েলাভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ফিল গানসন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ভাবছে, আমরা যদি এখন নৌবহরকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিই, তবে আমাদের অত্যন্ত আহাম্মক বলে মনে হবে এবং আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব।’

এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ছোটখাটো সামরিক হামলা চালিয়ে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করতে পারেন। এমন হামলার জন্য দুটি লক্ষ্যবস্তু বেছে নেওয়া হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার অবৈধ মাদক উৎপাদন কেন্দ্রে অভিযান চালাতে পারে। দেশটিতে মাদকবিরোধী অভিযানের অজুহাত কাজে লাগিয়েই মূলত হামলার হুমকি দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ভেনেজুয়েলায় এ ধরনের উৎপাদনকেন্দ্র খুব কম।

এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের গেরিলা শিবিরগুলোতে হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব ক্যাম্পের যোদ্ধারা সম্ভবত হামলার আগেই সরে পড়বেন।

আরও পড়ুন

পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযানের আশঙ্কা কতটুকু

খুব কম মানুষই মনে করেন, ট্রাম্প ভেনেজুয়েলায় পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালানোর ঝুঁকি নেবেন।

ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি অনেক বছর ধরেই বিপর্যয়ের মুখে আছে। এমন অবস্থায় দেশটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বা দখল নেওয়া একটি কঠিন কাজ হবে। তা ছাড়া, এ ধরনের বড় সামরিক অভিযানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সমর্থনও খুব একটা পাওয়া যাবে না।

তবে পূর্ণমাত্রার হামলা না করলেও যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারে। এর অংশ হিসেবে সরাসরি ভেনেজুয়েলার সরকারি বা সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হতে পারে।

খুব কম মানুষই মনে করেন, ট্রাম্প ভেনেজুয়েলায় পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালানোর ঝুঁকি নেবেন।

ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী হয়তো মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র বা যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করতে পারে। তবে তারা মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে না।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভেনেজুয়েলাভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ফিল গানসন বলেন, মাদুরো নিজেই পরিস্থিতিকে বড় যুদ্ধে রূপ দিতে চান না। কারণ তিনি জানেন, তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রকে উসকে দেন, তবে তাঁর সামরিক বাহিনী এক বা দুই দিনের বেশি টিকবে না।

মার্কিন অলাভজনক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের লাতিন আমেরিকার ফেলো উইল ফ্রিম্যান বলেছেন, ‘ট্রাম্প সম্ভবত চান, মাদুরো বিশ্বাস করুক যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা করাসহ যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।’

ভেনেজুয়েলায় বারবার ট্রাম্পের হামলার হুমকি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হলো, মাদুরো সরকার এবং তাঁর সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ ও ভয় তৈরি করা।

আরও পড়ুন

মাদুরো কি টিকতে পারবেন

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় মাদুরো এখন দুর্বল অবস্থানে আছেন। তবে এখনো তাঁর প্রতি সামরিক বাহিনীর পূর্ণ সমর্থন আছে।

ফিল গানসন বলেছেন, মাদুরোর প্রতি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জনসমর্থন থাকতে পারে, যা একেবারে নগণ্য নয়। কিন্তু একটি দেশ শাসন করার জন্য এই সমর্থন যথেষ্ট নয়, বিশেষ করে যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আছে। তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্পূর্ণভাবে সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্যের ওপর নির্ভর করছে।

ট্রাম্প সম্ভবত চান, মাদুরো বিশ্বাস করুক যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা করাসহ যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
উইল ফ্রিম্যান, লাতিন আমেরিকা ফেলো, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস

উইল ফ্রিম্যান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হামলা চালালেও মাদুরো ক্ষমতায় টিকে থাকবেন। মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিবর্তে ট্রাম্প অন্য কোনো বিষয়ে (যেমন মাদক পাচার বা অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ) একটি চুক্তি করে সেটিকে তাঁর অভিযানের সাফল্য হিসেবে প্রচার করতে পারেন।

ভেনেজুয়েলার দুই বৃহত্তম প্রতিবেশী কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের বামপন্থী শাসকেরা ট্রাম্পের এই সামরিক হস্তক্ষেপমূলক নীতির সমালোচনা করছেন। তবে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো এবং আর্জেন্টিনা ও পেরুর মতো ডানপন্থী দেশগুলো ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছেন।

ফিল গানসন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হলে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাবে ঠিকই, কিন্তু পর্দার আড়ালে অনেকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন।

আরও পড়ুন