গামা আর অবহেলা, এতেই বাড়ছে শিশুমৃত্যু

করোনায় প্রিয়জনকে হারানোর বেদনাফাইল ছবি: রয়টার্স

তীব্র জ্বরে ভুগছিল লেত সিয়া। কিছুতেই কমছিল না। দ্রুত তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন মা। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জানালেন দুসংবাদ, শিশুটি কোভিড–১৯ পজিটিভ। তবে চিকিৎসকেরা অভয় দিলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শিশুদের করোনা হলেও জটিলতা হয় না বললেই চলে। সেই আশ্বাসে মা আরিয়ানি রোক মারিনহেইরো আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের সিসিইউতে মারা যায় লেত সিয়া। সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, ‘আমাকে শূন্য করে দিয়ে এত দ্রুত সে চলে গেল। আমার সব ছিল ও।’

বেটার মতো গামা ভ্যারিয়েন্টটি আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে অনেকে বেশি সংক্রামক। আর এটি কোভিডে আক্রান্ত বা টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা অনেকাংশ ক্ষেত্রেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। এ ছাড়া গামার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার যে বৈশিষ্ট্য, এটিও শিশুদের সংক্রমণ, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল ব্রাজিল। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। মানাউসের একটি কবরস্থান
ছবি: রয়টার্স

সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্রাজিলে সংক্রামক রোগব্যাধিতে শিশুদের ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক বেশি। মৃত্যুর পাশাপাশি বিকলাঙ্গও হয়ে গেছে অনেকে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে যখন ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করল, তখন দেশটিতে যাঁরা মারা যান, এর অর্ধেকের বেশি ছিল শিশু। ২০১৫ সালে জিকা ভাইরাসের মহামারি শুরু হলে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা আক্রান্ত হতে শুরু করলেন। এরপর দেখা গেল, এ সময়ে ১ হাজার ৬০০ নবজাতক ছোট মাথা নিয়ে জন্ম নিয়েছে।

এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল ব্রাজিল। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই আছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। ব্রাজিলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সবচেয়ে ভীতিকর দিক হচ্ছে, এখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। আবার এ বয়সীদের শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিজের গবেষক ডা. ফাতিমা মারিনহো দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ব্রাজিলে ১০ বছরের কম বয়সী ২ হাজার ২০০ শিশু মারা গেছে। এই সংখ্যা দেশটির মোট মৃত্যুর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। আর মৃত শিশুদের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সীদের সংখ্যা ৯০০–এর বেশি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা গেলেও সেখানে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ১১৩।

তবে ব্রাজিলের এ সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, টেস্টের অভাবে অনেক মৃত্যু যে করোনাতেই হয়েছে, তা শনাক্তও হয়নি।

করোনা পরীক্ষার অপেক্ষায় এক শিশু। মানাউস, ব্রাজিল, মে ২০২০
ছবি: রয়টার্স

ফাতিমা মারিনহো বলেন, ‘আমরা সাও পাওলো রাজ্যের কিশোর ও শিশুদের আক্রান্তের হার নিয়ে গবেষণা করেছি। এই রাজ্য দেশটির ২০ শতাংশ জনসংখ্যার বসবাস। ২০২০ সালের শেষের দিক থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে দেখা গেছে অনেক শিশু আক্রান্ত ও হাসপাতাল ভর্তি। হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মধ্যে অর্ধকের বেশি ছিল নবজাতকসহ ৫ বছরের কম বয়সী। এদের সংখ্যা ছিল ৯০০–এর মতো।’

গবেষক ফাতিমা আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের ওপর করোনার ব্যাপক প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এই সংখ্যা অযৌক্তিকভাবে অনেক বেশি। পৃথিবীর আর কোথাও আমরা এমনটা দেখিনি।’

একই কথা আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের সংক্রামক রোগ–সম্পর্কিত কমিটির ভাইস চেয়ার ও শিশুদের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ সিন ও’লেরিরও। তিনি বলেন, ‘সংখ্যাটি বিস্ময়কর। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে যা দেখেছি, তার চেয়ে এটা অনেক বেশি।’

গত বছর যখন এই মহামারি শুরু হয়, তখন বড়রাই বেশি আক্রান্ত হতেন। শিশুরা ছিল অনেকটাই নিরাপদ। তাহলে এখন ব্রাজিলে কেন এত শিশু কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে?

ব্রাজিলে করোনার ‘পি১’ ধরনটি বেশি ছড়িয়েছে, যা এখন গামা নামে পরিচিত
প্রতীকী ছবি

ব্রাজিলে করোনার ‘পি১’ ধরনটি বেশি ছড়িয়েছে, যা এখন গামা নামে পরিচিত। বেটার মতো গামা ভ্যারিয়েন্টটি আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে অনেকে বেশি সংক্রামক। আর এটি কোভিডে আক্রান্ত বা টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা অনেকাংশ ক্ষেত্রেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। এ ছাড়া গামার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার যে বৈশিষ্ট্য, এটিও শিশুদের সংক্রমণ, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

ব্রাজিলের মানাউস শহরের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ফিওক্রুজ) সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ব্রাজিলে পি১ ধরনটি ক্রমাগত পরিবর্তিত (মিউটেশন) হচ্ছে। এর ফলে ভাইরাসটি আরও ভয়ানক হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ব্রাজিলে ১০ বছরের কম বয়সী ২ হাজার ২০০ শিশু মারা গেছে।
গবেষক ডা. ফাতিমা মারিনহো

সব বয়সী ব্যক্তিই গামার সংক্রমণের অনিয়ন্ত্রিত কবলে পড়েছে। আর এর অংশ হতে পারে শিশুরাও। যেসব অন্তসঃত্ত্বা নারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের ঝুঁকি অনেক বেশি। অসুস্থতার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের আগেই তাঁরা মৃত সন্তান জন্ম দিতে পারেন। এমনকি নবজাতকেরা জন্মের সময়ই মায়ের পেট থেকেই করোনা নিয়ে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যথাসময়ে শিশুরা উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণে মৃত্যুহার বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ থেকে উত্তোরণের উপায় হচ্ছে ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।

গবেষক ফাতিমা মারিনহো বলেন, ব্রাজিলে করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপে থাকা চিকিৎসকেরা প্রায়ই শিশুদের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। শিশুরা যখন অনেক অসুস্থ হয়ে ফিরে আসে, তখন চিকিৎসকদের মধ্যে সন্দেহ জন্মে যে এরা করোনায় আক্রান্ত হতে পারে।

টেক্সাস চিলড্রেনস হসপিটালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের প্রধান ডা. লারা শেকেরদেমিয়ান বলেন, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা খুব কম। কিন্তু যেখানে চিকিৎসাসুবিধার ঘাটতি রয়েছে, সেখানে শিশুদের অবস্থা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রধান শিকার হয় শিশুরা। ব্রাজিলে এখন করোনার যেই ধরনটি বিরাজ করছে, তা শিশুদের প্রতিরোধক্ষমতাকে দ্রুত ধ্বংস করে দেয়। এর কারণে একসঙ্গে শিশুর অনেকগুলো অঙ্গে প্রদাহ হতে পারে। হৃদ্‌যন্ত্রও আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি শিশুরা টক্সিক শকে চলে যেতে পারে।

আজ যেই শিশুর শুধু একটু অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়েছে, তাকে তা না দেওয়া হলে আগামী সপ্তাহে ভেন্টিলেটরের সুবিধা লাগবে। আজ যে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করলেই সামান্য চিকিৎসাতেই সুস্থ হতে পারত, কিন্তু এতে বিলম্ব করলেই তার অবস্থা এতটাই জটিল হয়ে উঠতে পারে যে তার সেরে ওঠা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

ব্রাজিলের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগী বন্যার স্রোতের মতো আসছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

করোনা মহামারি শুরুর আগেও ব্রাজিলের দরিদ্র এলাকায় লাখ লাখ মানুষ তেমন স্বাস্থ্যসেবা পেতেন না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। কারণ, বন্যার স্রোতের মতো সেখানে রোগীরা ভিড় করছেন। ফলে চিকিৎসক চাইলেও সেবা দিতে পারছেন না। এ ছাড়া আছে নানা প্রতিবন্ধকতা।

মানাউসের হেইটর ভিয়েরা দৌরাদো ট্রপিক্যাল মেডিসিন ফাউন্ডেশনের শিশুদের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনা লুইসা পাচেকো বলেন, অনেকের জন্য স্বাস্থ্যসুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে হাসপাতালে আসতে গেলে ৩-৪ ঘণ্টার নৌপথ পাড়ি দিতে হয়।

গত জানুয়ারিতে পেডিয়াট্রিক ইনফেকশাস ডিজিজ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীন, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার তুলনায় ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার চারটি দেশের শিশুদের মধ্যে করোনায় ধরনটি গুরুতর। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (শরীরের ভেতরের অনেকগুলো অঙ্গে একসঙ্গে প্রদাহ) দেখা যায়।

বলসোনারো মনে করেন, যাঁরা টিকা নিয়েছেন ও আগে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই।
ছবি: রয়টার্স

ব্রাজিলে শিশুদের মধ্যে এই সংক্রমণের মাত্রা ব্যাপক বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেশটির প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর একগুঁয়েমিকেও দায়ী করা যায়। তিনি করোনার সংক্রমণ রোধে বরাবরই লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিরোধী। দেশটিতে করোনা মহামারির মধ্যে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। খাবারের অভাব রয়েছে। তাই নিজের খাদ্য জোটাতে জন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন। তাঁদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। অজান্তেই আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই আগে থেকে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। কিন্তু মারিনহো বলছেন, ১০ বছরের কম বয়সী যত শিশু মারা গেছে, তাদের এক–দশমাংশ মাত্র দুর্বল স্বাস্থ্যের শিশু ছিল। তার মানে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিশুরাও ব্রাজিলে উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যারিনার প্রতিবেদনে বলা হয়, টেস্টের কিটের ঘাটতি হলে এর প্রধান শিকার হয় শিশুরা। ব্রাজিলে এখন করোনার যেই ধরনটি বিরাজ করছে, তা শিশুদের প্রতিরোধক্ষমতাকে দ্রুত ধ্বংস করে দেয়। এর কারণে একসঙ্গে শিশুর অনেকগুলো অঙ্গে প্রদাহ হতে পারে। হৃদ্‌যন্ত্রও আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি শিশুরা টক্সিক শকে চলে যেতে পারে। শুরুতেই চিকিৎসা পেলে হয়তো তাদের অবস্থা অতটা গুরুতর হতো না।

এমন পরিস্থিতিতে সদ্য হাঁটতে শেখা সন্তান লেত সিয়াকে হারানো মা আরিয়ানি রোক মারিনহেইরো সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি এখনো মনে করেন, হয়তো আরও আগে সুচিকিৎসা পেলে তাঁর সন্তানটি বেঁচে যেত। তিনি বলেন, ‘এট অনেকটা লটারির মতো। এই ভাইরাসে যে নিজেদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত হতে পারে, তা আমরা বিশ্বাসই করতে চাই না, কিন্তু যখন এই ভাইরাস কাউকে কেড়ে নেয়, তখনই তা উপলব্ধি করা যায়।’