বলসোনারোর কপালে ভাঁজ

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাজনীতিতেও মাঝেমধ্যে ‘ভূমিকম্প’ হয়। ঠিক যেমনটা হয়েছে ব্রাজিলে। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতির চমকপ্রদ রায়ে ব্রাজিলের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভার ফের রাজনীতিতে নেমে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ খুলেছে। আর এমন নাটকীয় ঘটনায় কপালে ভাঁজ পড়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর।

লুলা সাবেক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। নয়া লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের ‘পোস্টার বয়’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লুলা। তাঁর আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ব্রাজিল দারুণ সাফল্য অর্জন করে। ২০১৮ সালে তিনি তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির বিতর্কিত অভিযোগে তাঁর জেল হয়। রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে ব্যর্থ হন।

২০১৮ সালের এপ্রিলে লুলা কারাগারে যান। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট পর্যালোচনার বিষয়ে সম্মত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তিনি ছাড়া পান। মোট ৫৮০ দিন জেল খাটেন লুলা।

৮ মার্চ লুলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিন মামলার সাজা ‘টেকনিক্যাল’ কারণে বাতিল করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি। এই পদক্ষেপই ব্রাজিলের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কেননা, সুপ্রিম কোর্টের এমন সিদ্ধান্তের ফলে লুলার ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

লুলার দণ্ড বাতিল হওয়ায় তাঁর সমর্থকেরা ও তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা বেশ উৎফুল্ল। পাশাপাশি লুলার সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে ব্রাজিলের রাজনীতির মাঠ ইতিমধ্যে গরম হয়ে উঠেছে।

তবে লুলার প্রার্থিতা কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছে। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের রায়েও লুলাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়নি। তার মানে তাঁকে আবার বিচারের মুখোমুখি করা যাবে। কিন্তু ব্রাজিলের বিচারব্যবস্থা বেশ জটিল ও ধীরগতি সম্পন্ন। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হলে লুলার আবার দণ্ড হতে হবে। আর সেই দণ্ড আপিল আদালতেও বহাল থাকতে হবে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

দণ্ড বাতিলের পর প্রথম প্রকাশ্য বিবৃতিতে লুলা বলেন, ২০২২ সালের নির্বাচনে তিনি লড়বেন কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। পরে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তাঁকে অনেকটাই নির্বাচনী প্রচারের ভঙ্গিতে দেখা যায়। করোনা মোকাবিলায় নিয়ে তিনি বলসোনারোকে আক্রমণ করেন। লুলা নিজেকে একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বর্ণনা করেন। ব্রাজিলে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেন। মুক্ত গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী নেতা, সেনাবাহিনীর প্রতি তিনি তাঁর শ্রদ্ধার কথা জানান। বলসোনারোকে পরাজিত করতে একটি বৃহৎ নির্বাচনী জোট গঠনের আহ্বান জানান লুলা।

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

লুলার এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রভাব লক্ষ করা যায় বলসোনারোর আচরণে। লুলার বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মাথায় বলসোনারো ও তাঁর সহযোগীরা একটি সরকারি অনুষ্ঠানে হাজির হন। এ সময় তাঁদের সবাইকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখা যায়। অথচ অতীতে বলসোনারোকে মাস্ক পরার ব্যাপারে ব্যাপক অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।

বলসোনারো এখন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন, যেন লুলা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। তবে বলসোনারো যে উদ্বিগ্ন, তার প্রমাণ তাঁর কথাবার্তায় ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লুলা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও তাঁর সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে বলসোনারো কথা বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, ২০২২ সালের নির্বাচনে ব্রাজিলের জনগণ লুলার মতো একজনকে প্রার্থী হিসেবে চাইবে না বলেই তিনি মনে করেন। তাই তিনি তাঁর সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। একই সঙ্গে বলসোনারো বলেছেন, লুলার প্রশাসন ছিল ভয়াবহ।

লুলা যদি সত্যিই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন, তাহলে তা বলেসোনারোর পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের লাতিন আমেরিকার ইতিহাসবিষয়ক শিক্ষক রাফায়েল আর আয়োরিস মনে করেন, ব্রাজিলের রাজনৈতিক অঙ্গনে লুলার ফিরে আসার বিষয়টি একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বহাল থাকতে পারে। বলসোনারো পুনর্নির্বাচনের জন্য লড়বেন। কিন্তু লুলা প্রার্থী হলে বা তিনি কোনো বামপন্থী প্রার্থীকে সমর্থন দিলে, তা কট্টর রক্ষণশীল বলসোনারোর জন্য সুস্পষ্ট হুমকি হয়ে উঠবে।

লুলার সময় ব্রাজিলের অর্থনৈতিক অবস্থা ও কর্মসংস্থানের সূচক বেশ ভালো ছিল। তাঁর সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত লুলার প্রশংসা করেছিলেন। লুলা যখন ক্ষমতা ছাড়েন, তখন তাঁর জনসমর্থন ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। এক দশকের ব্যবধানে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক কমেছে। তারপরও তিনি বলসোনারোর চেয়ে জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে। ফরেন পলিসি জানায়, সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বলসোনারোকে এখন হারানোর মতো ব্রাজিলে একমাত্র যে ব্যক্তি আছেন, তিনি লুলা। জরিপে ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণ বলেছেন, তাঁরা লুলাকে ভোট দেবেন। আর ৩৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বলসোনারোর পক্ষে।

লুলার ফিরে আসাটা রাজনৈতিকভাবে বলসোনারোর জন্য একটি খারাপ সংবাদ বলে মনে করেন টাইম সাময়িকীর এডিটর অ্যাট-লার্জ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের কলাম লেখক ইয়ান ব্রেমার। বলসোনারোর পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে লুলা যে একটা বড় হুমকি হবেন, সে কথা আন্তর্জাতিক বিষয়ের কলাম লেখক ফ্রিদা ঘাইটিসের নিবন্ধেও উঠে এসেছে।