পুরুষের জন্মনিরোধক পিল এখনো না আসার অদ্ভুত কারণ

পুরুষের জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকর পিল নিয়ে গবেষণা চলছে অর্ধশতাব্দী ধরে।
ছবি: এএফপি

অর্ধশতাব্দীতে পুরুষের জন্মনিরোধক পিলের জন্য অসংখ্য সম্ভাব্য পদ্ধতির প্রস্তাব করেছেন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। এর কোনোটার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে, কোনোটার প্রস্তাব শুরুতেই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও এত বছরে পুরুষদের জন্য কোনো জন্মনিরোধক পিল আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, গ্রহণযোগ্যতার কঠোর মানদণ্ড, পুরুষের অনীহা এবং তহবিলসংকটের কারণে বারবার পুরুষের জন্মনিরোধক পিল তৈরির প্রকল্প বাতিল হয়েছে। তবে চলতি সপ্তাহে ইঁদুরের ওপর এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণায় নতুন ফল পাওয়া গেছে। এখন এই গবেষণা কত দূর এগোবে, তা নিয়েও নানা মত রয়েছে।

গবেষণার শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত একজন তরুণ চিকিৎসার জন্য একধরনের ওষুধ খেতেন। কিন্তু এই ওষুধ খাওয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করতে থাকেন। জানিয়েছিলেন, এই ওষুধ খাওয়ার পর থেকে তাঁর যৌন সক্ষমতা কমে গেছে।

প্রায় তিন দশক পর এ ঘটনা থেকে নতুন ভাবনা শুরু হয়। এ ধরনের ওষুধের ওপর ভিত্তি করে পুরুষের জন্মনিরোধক পিল তৈরির কথা ভাবেন গবেষকেরা। গবেষকেরা বীর্যপাতে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন ধরনের একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন। গবেষকদের মূল ভাবনা ছিল, ওষুধটি কীভাবে কাজ করে, তা পর্যবেক্ষণ করা। গবেষকেরা ‘ক্লিন-শিটস’ নামে এ ধরনের একটি পিল বানালেও তহবিলের অভাবে এই গবেষণা আর এগোয়নি। বেশির ভাগ পুরুষও এটা সহজভাবে নেননি।

চলতি সপ্তাহে ইঁদুরের ওপর এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণা আলোচনায় আসে। গবেষণায় ব্যবহৃত একটি মলিকুলার সুইচ শুক্রাণু দুই ঘণ্টার জন্য নিশ্চল করে দিতে পারে। ফলে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হতে পারে না।

এরপর পুরুষদের পিল নিয়ে গবেষণায় সাফল্য আসেনি। চলতি সপ্তাহে ইঁদুরের ওপর এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণা আলোচনায় আসে। গবেষণায় ব্যবহৃত একটি মলিকুলার সুইচ শুক্রাণু দুই ঘণ্টার জন্য নিশ্চল করে দিতে পারে। ফলে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হতে পারে না। তবে মানুষের শরীরে ব্যবহারের জন্য আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

নৈতিকতার প্রশ্ন

পুরুষের জন্মনিরোধক পিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেন এত জটিল ও গ্রহণযোগ্য নয়, তা বোঝার জন্য ১৯৫০–এর দশকের শেষের দিকে ফিরে যেতে হবে। সেই সময় নারীদের জন্মনিরোধক পিল প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল। সে সময় ওই পিলের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কোনো ব্যাপকতা ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত মান ছিল না। ওষুধটি (ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের একটি তুলনামূলকভাবে উচ্চ ডোজের সংমিশ্রণ) পুয়ের্তো রিকোর মতো বেশ কয়েকটি দেশে বিতর্কিতভাবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছিল। সে সময় মাত্র ১ হাজার ৫০০ নারীর ওপর পিলটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে তিনজন নারীর মৃত্যু হয়। যদিও এর অর্ধেক নারীর ওপর পুরোমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়নি। পরে ১৯৬০ সালে পিলটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) চূড়ান্ত প্রয়োগের অনুমোদন দেয়।

পুরুষের জন্মনিরোধক পিলের জন্য অসংখ্য সম্ভাব্য পদ্ধতির প্রস্তাব করেছেন গবেষকেরা।
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

এরপর ১৯৬৪ সালে আবার সবকিছু বদলে যায়। আন্তর্জাতিক কনফেডারেশন অব মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন স্বাস্থ্যনীতির একটি নতুন বিধির প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে।

পরে হেলসিংকি ঘোষণায় স্বাস্থ্যনীতির একটি বিশেষ বিধির কথা বলা হয়। ওই বিধিতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময় অংশগ্রহণকারীদের ঝুঁকির বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

যুক্তরাজ্যের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মনিরোধক ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুসান ওয়াকার বলেন, এরপর ওষুধ গবেষণার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে ভাবনা বদলেছে। এ বদল আসার আগেই পিল চালু হয়ে গিয়েছিল। তবে বদল আসার পরে পিল বানাতে আরও বেশি সাবধানতা ও কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।  
নারীদের পিলের আধুনিক সংস্করণগুলো নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে পিলগুলো খুব কম কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্ত ​​​​জমাট বাঁধার মতো জটিলতা ঘটাতে পারে। তবে এই পিল মেজাজের ওঠানামা, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, স্তনের পরিবর্তনসহ বেশ কয়েকটি কম গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ আছে যে এই পিল শরীরের আকৃতিরও পরিবর্তন করতে পারে।
এসব কারণেই পুরুষের জন্য জন্মনিরোধক পিলের ক্ষেত্রে উচ্চতর মানদণ্ড বজায় রাখা হচ্ছে। সুসান ওয়াকার বলেন, এই পিলের ট্রায়ালে পুরুষের সঙ্গিনীর অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি রয়েছে। এ কারণে ঝুঁকির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নারীদের পিলের আধুনিক সংস্করণগুলো নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে পিলগুলো খুব কম কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্ত ​​​​জমাট বাঁধার মতো জটিলতা ঘটাতে পারে। তবে এই পিল মেজাজের ওঠানামা, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, স্তনের পরিবর্তনসহ বেশ কয়েকটি কম গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ৭০০ নারী গর্ভাবস্থা ও প্রসবজনিত জটিলতার কারণে মারা যায়। আর প্রায় ৫০ হাজার নারী স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি মাতৃত্বজনিত জটিলতায় ভোগেন। বিশ্বব্যাপী প্রসবের সময় ও পরে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়।

১৯৭০-এর দশকে পুরুষের জন্য হরমোনাল জন্মনিরোধক পিলের অসংখ্য সংস্করণ তৈরি করা হয়। সে সময় গবেষকেরা কয়েক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন দিয়েছিলেন। সে সময় এই ইনজেকশন শুক্রাণু উত্পাদনকে প্রভাবিত করেছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। একটি প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পিলটি অসাধারণভাবে কাজ করছে। পরবর্তী গবেষণায় এর সঙ্গে নারী প্রজনন হরমোন প্রোজেস্টেরনের একটি কৃত্রিম সংস্করণ যোগ করে দেখা হয় কার্যকারিতা আরও বাড়ে কি না।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ৭০০ নারী গর্ভাবস্থা ও প্রসবজনিত জটিলতার কারণে মারা যায়। আর প্রায় ৫০ হাজার নারী স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি মাতৃত্বজনিত জটিলতায় ভোগেন। বিশ্বব্যাপী প্রসবের সময় ও পরে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়।

এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা ছিল হরমোন থেরাপির অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ব্রণ, তৈলাক্ত ত্বক ও ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে টেস্টোস্টেরন হরমোন। এ কারণে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু পরীক্ষামূলক প্রয়োগ স্থগিত করে দেওয়া হয়।

গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড

পুরুষদের জন্য হরমোনাল নয়, এমন বেশ কয়েকটি জন্মনিরোধক পিলেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি টিকা রয়েছে, যা শুক্রাণুর পরিপক্বতার সঙ্গে জড়িত। এই পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণু বের হওয়ার পথে বাধা তৈরি করা হয়। এই টিকার মাধ্যমে পুরুষের একধরনের অস্থায়ী ভ্যাসেকটমি (বন্ধ্যাকরণের জন্য অস্ত্রোপচার) করা হয়।  
এই পদ্ধতি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে রয়েছে। অনুমোদন হওয়ার আগে ভারতে এর চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে।

তবে ক্লিন-শিটস জন্মনিরোধক পিলের মতো হরমোনাল নয়, এমন পিলও কিছু পুরুষের কাছে অপ্রীতিকর মনে হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুরুষেরা এই পিল ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজননক্ষমতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কী রকম প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েও তাঁরা বেশ চিন্তিত।
সুসান ওয়াকার, অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মনিরোধক ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক

সুসান ওয়াকার বলেন, পুরুষেরা এই পিল ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজননক্ষমতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কী রকম প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েও তাঁরা বেশ চিন্তিত।

এই পিলের ক্ষেত্রেও তহবিল একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্লিন-শিটস পিলের ক্ষেত্রে একটি মার্কিন অলাভজনক সংস্থা পার্সেমাস ফাউন্ডেশন সমীক্ষা চালিয়েছিল। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন তাঁরা এটি গ্রহণ করবেন না, ২০ শতাংশ বলেছেন গ্রহণ করবেন। আর বাকিরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন বলে জানিয়েছেন। এসব করতে করতে প্রাণী ও মানুষের ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগেই প্রকল্পটির তহবিল শেষ হয়ে গেছে। নতুন তহবিলও আর আসেনি।

সুসান ওয়াকার বলেছেন, পুরুষদের জন্মনিরোধক নিয়ে গবেষণার অর্থায়নের জন্য বেশ কিছু দাতব্য সংস্থা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তবে অনুমান করা যায়, নারীদের জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলো ভালো কাজ করছে বলে ওষুধ কোম্পানিগুলো পুরুষদের জন্মনিরোধকের ক্ষেত্রে কম উৎসাহ ও অনুদান দেবে।    

সুসান ওয়াকার জন্মনিরোধক এবং প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন। পুরুষদের জন্য শিগগিরই জন্মনিরোধক পিল আসবে বলে তিনি আশা করছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি আর [এ বিষয়ে] আশাবাদী নই। প্রতিটি পদ্ধতির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড বড় বাধা হয়ে আসছে।’ তবে চলতি সপ্তাহে ইঁদুরের ওপর যে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, তাতে সফলতা আসতেও পারে।