বিশ্বের বড় বড় উৎসব কোথায় হয়

অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক সম্পদ আর সুস্বাদু খাবার—এগুলো তো আছেই; তবে কোনো দেশকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে চাইলে দেখতে হবে তারা কীভাবে উৎসব করে। উৎসব মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তা হতে পারে পবিত্র বা সাধারণ, প্রথাগত বা প্রথাভঙ্গকারী, অদ্ভুত কিংবা বিপজ্জনক।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের উৎসব উদ্‌যাপন করা হয়। রিওতে নাচা, ওয়াক্সাকাতে কঙ্কালের মতো করে সাজা, সিউলে কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া অথবা শেটল্যান্ডে ভাইকিং সেজে মেতে ওঠা—প্রতিটি মুহূর্তই যেন উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস বিশ্বের বিভিন্ন উৎসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনের আলোকে বিশ্বের ১০টি ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তথ্য প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

রিও কার্নিভ্যাল, ব্রাজিল

রিও কার্নিভাল
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ব্রাজিলের রাজধানী রিওতে ব্যতিক্রমধর্মী এ কার্নিভ্যালের আয়োজন করা হয়। পৃথিবীর আর কোনো শহরে রিওর মতো এত বড় পথ উৎসবের আয়োজন হয় না। রিও কার্নিভ্যালে ১০ দিন ধরে অবিরাম চলে সাম্বা নাচ, ঝলমলে গাড়ি প্রদর্শন। সর্বাত্মক উৎসবের আমেজ বিরাজ করে এবং রাস্তাগুলো আনন্দমুখর থাকে। এই কার্নিভ্যাল তিনটি অংশে বিভক্ত। টিকিট কেটে দেখা যায়—এমন প্যারেড (স্যাম্বোড্রোমো স্টেডিয়ামে), টিকিট কিনে অংশ নেওয়া বল বা নৃত্যানুষ্ঠান এবং সবার জন্য উন্মুক্ত আনন্দ আয়োজন।

প্যারেড অবশ্যই দেখা উচিত। তবে রোববার বা সোমবারে আয়োজিত ‘স্পেশাল গ্রুপ’ প্যারেডগুলোয় সেরা পরিবেশনাগুলো হয়ে থাকে। বল অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোপাকাবানা প্যালেসে আয়োজিত তারকায় ভরপুর ম্যাজিক বল সবচেয়ে আলোচিত। তবে এর টিকিটের দাম বেশ বেশি। খরচ এড়াতে চাইলে স্কালা ক্লাবে রাত্রিকালীন আয়োজন গালা পার্টি অথবা ব্লকোসে (স্থানীয় রাস্তার পার্টি) গিয়ে বিনা মূল্যে নাচা যায়।

হোলি, মথুরা

হোলি উৎসব
বি: রয়টার্স ফাইল ছবি

সনাতন ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভারতের মথুরায় রং ছোড়ার ঐতিহ্যের সূচনা করেছিলেন। দিল্লি থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার একটু বেশি দূরত্বে থাকা এই ছোট্ট শহর আজও উৎসাহ-উল্লাসে রং ছোড়ার উৎসব উদ্‌যাপন করে। এ উৎসবের নাম হোলি। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এ উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন তারিখ হয়ে থাকে। তবে সাধারণত মার্চ মাসে এর আয়োজন হয়।

মথুরার শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরটি উৎসবের ড্রাম বাজানোর প্রাণকেন্দ্র। হোলি উৎসব চলাকালে মন্দিরের সামনের রাস্তাটি যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সেখানে যে কেউই রঙের লক্ষ্য হতে পারে! রং ছোড়াছুড়ির এ উৎসব শেষে মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত উজ্জ্বল রঙে ঢাকা পড়ে যায়। তাই উৎসবে অংশ নেওয়ার সময় লম্বা হাতার জামা ও ফুলপ্যান্ট পরার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

ডে অব দ্য ডেড

ডে অব দ্য ডেড উৎসব
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

মেক্সিকোয় আয়োজিত ‘ডে অব দ্য ডেড’ বা মৃত ব্যক্তিদের স্মরণোৎসব পৃথিবীর সবচেয়ে উন্মাদনাপূর্ণ হ্যালোইন উৎসব। এক সপ্তাহ ধরে চলে এ উৎসব। তবে মূল আয়োজন হয় প্রতিবছরের ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত। এ উৎসবের সময় রাস্তায় মানুষেরা কঙ্কাল সেজে হাঁটে আর রাতভর পার্টি করে।

এ হ্যালোইনে অংশ নেওয়ার আগে মুখোশ কিনতে হয়। আতজোম্পা শহরের বাজারেই কিনতে পাওয়া যায় মুখোশ। এরপর অন্ধকার নেমে এলে কোনো সমাধিস্থলে চলে যেতে হয়। বেশির ভাগ মানুষ পান্তেওন সান মিগুয়েল সমাধিতে যায়। তুলনামূলক শান্ত পরিবেশ চাইলে সান্তা ক্রুজ কোকোকতলানের সমাধিস্থলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

১ নভেম্বর হয়ে থাকে কম্পারসা প্যারেড। তবে শহরের কেন্দ্রস্থলের প্যারেডটা একটু বেশি পর্যটনকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ১২ মাইল উত্তরে সান অগুস্তিন এটলা শহরে গেলে দেখা যায়, ক্যালাকাসরা বা কঙ্কালরূপী মানুষেরা ঘরে ঘরে গিয়ে ড্রাম বাজাচ্ছে আর টাকিলা পান করছে।

ভেনিস কার্নিভ্যাল

ভেনিস কার্নিভ্যাল
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিশ্বের কয়েকটি উৎসবই ভেনিস কার্নিভ্যালের মতো ঐতিহ্য ধারণ করে। এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল ১১৬২ সালে। তবে ১৭৯৭ সালে উৎসবে অশ্লীলতা হয়—এমন অভিযোগ তুলে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭০-এর দশকের আগপর্যন্ত তা নিষিদ্ধ ছিল। সত্তরের দশক থেকে আবারও এ উৎসব উদ্‌যাপন শুরু হয়।

ভেনিস কার্নিভ্যাল মূলত অদ্ভুত পোশাক পরার এক উৎসব। যে যত বেশি বর্ণাঢ্য ও অদ্ভুত পোশাক পরবে, তত ভালো। তবে ভেনিস কার্নিভ্যাল সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত মুখোশের জন্য। অদ্ভুত, ভৌতিক, হাস্যকর আর কখনো কখনো ভয়ংকর সব মুখোশ পরা হয়, যা কার্নিভ্যালের অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

কীভাবে এই মুখোশের ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে বলা হয়ে থাকে, এই মুখোশ পরার মধ্য দিয়ে পরিধানকারীরা একধরনের স্বাধীনতা ও অজ্ঞাতনামা হয়ে থাকার সুযোগ উপভোগ করেন। নিজেদের দৈনন্দিন পরিচয় ভুলে গিয়ে একেবারে মুক্ত ও উদ্দাম হয়ে ওঠার সুযোগ পান তাঁরা।

বোরিয়ং মাড ফেস্টিভ্যাল

মাড ফেস্টিভ্যাল
ছবি: এপি ফাইল ছবি

মাটি মেখে গড়াগড়ি খাওয়াই এ উৎসবের আসল অংশ। উৎসবটি দক্ষিণ কোরিয়ার ছোট্ট শহর বোরিয়ংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সিউল থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণে বোরিয়ং শহরের অবস্থান। সেখানকার চারপাশে রয়েছে খনিজসমৃদ্ধ কাদামাটি। এ মাটিকে ত্বকের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়।

মূলত স্থানীয় প্রসাধনীশিল্পের প্রচারের উদ্দেশ্যে এ উৎসবের সূচনা হয়েছিল। তবে এখন উৎসব অনেক জনপ্রিয়। অসংখ্য কোরীয় ও বিদেশি পর্যটক কাদা মাখামাখির উৎসবে যোগ দিতে বোরিয়ং শহরে ভিড় জমান। সাধারণত জুলাই মাসে এ উৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে।

প্রতিবছর উৎসবে নতুন নতুন আয়োজন যোগ হয়। তবে কাদায় স্কিইং করা, কাদায় কুস্তি করা আর কাদা দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করাটা সব সময়ই উৎসবের অংশ হয়ে থাকে।

মিউনিখের অক্টোবর ফেস্ট

২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত এই উৎসব চলে। নিঃসন্দেহে এটি বিয়ারপ্রেমীদের জন্য সেরা উৎসব। স্থানীয় বাসিন্দারা লেদেরহোসেন (একধরনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) পরে ঘোরেন। সেখানে ‘ওমপাহ’ ব্যান্ডের সংগীতের তালে তালে তাঁরা বিয়ার খান। থেরেসিয়েনভাইজে নামের স্থানে বিশাল আকারের ১৪টি তাঁবু তৈরি করে দেশি-বিদেশি নানা ধরনের বিয়ার পরিবেশন করা হয়।

সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আর সপ্তাহান্তে ও সরকারি ছুটির দিনে সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিয়ার দেওয়া হয়। বেলা ২টা ৩০ মিনিটের পর মূল তাঁবুগুলোয় আসন পেতে হলে আগে থেকেই বুকিং দিতে হয়। তবে বুকিং পাওয়া না গেলে শহরের অন্যান্য পাব ও বিয়ার হলগুলোতেও বিয়ারভিত্তিক এ উৎসবের মজা চালিয়ে যাওয়া যায়।

নিউ অরলিন্সের মারডি গ্রাস উৎসব

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে হওয়া এ উৎসব উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে উন্মাদনাপূর্ণ পথ উৎসব। এখানে রাস্তায় বর্ণিল সব ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ ঘুরে বেড়ায়। সেখান থেকে ছুড়ে দেওয়া হয় প্লাস্টিকের মালা, খেলনা ও পানীয়। পাঁচ দিন ধরে প্যারেড চলে। মার্চে এই উৎসব হয়ে থাকে।

প্রধান উৎসবমুখর রাস্তা হলো বোরবন স্ট্রিট। বড় প্যারেডগুলো সন্ধ্যা সাতটার দিকে শুরু হয়। ক্যানেল স্ট্রিটের উত্তর বা পূর্ব দিকে ব্যারিকেডের পাশে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে সহজেই ‘থ্রোজ’ ধরা যায়। থ্রোজ হলো ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ থেকে ছোড়া প্লাস্টিকের মালা ও খেলনা। ফরাসি-প্রভাবিত ফ্রেঞ্চম্যান স্ট্রিটের জ্যাজ বারে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যায়।

বেলফাস্টের সেন্ট প্যাট্রিকস ডে

সাধারণত মার্চে হয়ে থাকে এই উৎসব। এবারও মার্চ মাসে হয়ে গেল। আয়ারল্যান্ডের এ উৎসব অনেক মজার। একই সঙ্গে হাসি-আনন্দ আর শ্যামরকের (একধরনের ছোট উদ্ভিদ) মিশ্রণের স্বাদ নিতে চাইলে বেলফাস্টে যেতে হবে।

ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট থেকে একগুচ্ছ শ্যামরক কিনে দুপুরের প্যারেডে অংশ নেওয়া যায়। প্যারেডটি অনুসরণ করে কাস্টম হাউস স্কয়ারে চলে যেতে হবে। সেখানে চলবে খাবার ও পানীয়। বিকেলজুড়ে সরাসরি উপভোগ করা যায় সংগীতের উৎসব।

লা তমাতিনা, বুনিওল

লা তমাতিনা
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

১৯৪৫ সাল থেকে স্পেনের ছোট শহর ভ্যালেন্সিয়ানে এ উৎসব উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উন্মাদনাপূর্ণ পথ উৎসবগুলোর একটি। লা তমাতিনা উৎসব প্রতিবছর আগস্টের শেষ বুধবারে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এর উৎপত্তি কবে, তা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই।

এ উৎসবের মূল ব্যাপারটা হলো, সামনে যাকেই পাও, তার দিকে পচা টমেটো ছুড়ে মারো। টমেটো যত নরম হবে, তত ভালো। মূল টমেটো ছোড়ার উৎসব শুরু হয় বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কোনো এক সময়ে। বিশাল ট্রাক থেকে অসংখ্য নরম টমেটো ঢেলে দেওয়ার পরই ছোড়াছুড়ি শুরু হয়।

একটি বন্দুক থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে খেলাটি শুরু হওয়ার সংকেত দেওয়া হয়। এই টমেটো নিক্ষেপ সাধারণত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে। তারপর সবাই গোসল করতে চলে যায়। ফায়ার ট্রাক এসে পুরো জায়গা ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলে এবং দিনের শেষে মনে হয় যেন কিছুই ঘটেনি।

১০

সংক্রান, চিয়াংমাই, থাইল্যান্ড

সংক্রান উৎসব
ছবি: এএফপি ফাইল

একই ধরনের আরেকটি উৎসব হলো সংক্রান, যা থাই নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত হয়। এ উৎসবে অপরিচিত মানুষদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়াই নিয়ম!

পানি ছিটানোকে মূলত পবিত্রতা অর্জনের প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়। তবে বাস্তবে এটি বিশাল এক পানিযুদ্ধে রূপ নেয়।

উচ্চ ক্ষমতার ওয়াটারগান, জলবোমা, পাইপ বা হোস পাইপ, এমনকি বালতি—সবকিছুই যেন এখানে বৈধ অস্ত্র!

থাইল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি শহরে নিজস্ব সংক্রান উৎসব হয়। তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাইলে উত্তরের ছোট শহর চিয়াংমাইতে যাওয়াই ভালো। বিদেশিরা (থাই ভাষায় ফারাং) এখানে বিশেষ লক্ষ্যবস্তু অর্থাৎ যেখানে যেখানে বেশি পর্যটক থাকেন, সেখানেই পানি ছিটানো বেশি হয়। এ বছর ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল এই উৎসব হয়ে গেল।