অভিবাসন সংস্কার নিয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নিজ দলকেই এক করতে পারছেন না প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই সমন্বিত অভিবাসন সংস্কার আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ৩০ দিনের মধ্যে বেশ কিছু নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন।

ডেমোক্রেটিক দলের বেশ কিছু আইন প্রণেতা মনে করছেন, একসঙ্গে অভিবাসন ব্যবস্থার সব সমস্যা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ ব্যর্থ হবে। ভেঙে পড়া অভিবাসন ব্যবস্থার আংশিক সমস্যাগুলো একে একে সংস্কার করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন কিছু ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত অভিবাসনের অন্তত ১০টি সমস্যাকে লক্ষ্য করে কাজ শুরু করেছেন। অভিবাসন নিয়ে চরম বিভক্ত মার্কিন সমাজে তাঁর উদ্যোগ এর মধ্যেই বাঁধার মুখে পড়েছে। অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে সহসাই তুমুল বিতর্ক শুরু হওয়ার আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ নীতিগুলোর মধ্যে অভিবাসনবিরোধী নীতিমালা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠীর জন্য চরম অসহিষ্ণুতার কারণ হয়ে উঠেছিল। মার্কিন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী চলমান অভিবাসন বাস্তবতায় বিপুলসংখ্যক বাদামি চামড়ার মানুষের আগমনকে ভালো চোখে দেখছে না।

গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে খুব কমই আসছে। বেশি আসছে দক্ষিণ আমেরিকাসহ এশিয়ার দেশ থেকে। অভিবাসনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ বছরে মার্কিন জনসংখ্যার অনুপাত পুরো পাল্টে যাবে বলে বলা হচ্ছে।

মার্কিন রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ মানুষের সমর্থন পেতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো রাখঢাক না করেই অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন। নির্বাচনে হারলেও ট্রাম্পের সমর্থনে এককাট্টা শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীদের ব্যাপক সমর্থনের কারণ তাঁর অভিবাসনবিরোধী অবস্থান।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচার থেকেই বলে আসছিলেন, নির্বাচিত হলে অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন। ক্ষমতার প্রথম দিন থেকেই একটি মানবিক অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন আপাতত তাঁর কথা রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন।

অভিবাসনের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়, অভ্যন্তরীণ ধরপাকড়, সীমান্ত দেয়াল, শরণার্থীদের আশ্রয়, মুসলিম প্রধান কিছু দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, অভিবাসন আবেদনের বেলায় আরোপিত নিয়মাবলি শিথিল করা বা পুনর্মূল্যায়ন করার ইস্যু নিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করেন।

সীমান্ত দিয়ে আসা অভিবাসীদের শিশু সন্তানদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না করা, অল্প বয়সে মা–বাবার সঙ্গে আসা সন্তানদের বৈধতা দান, ইতিমধ্যে বিতাড়নের আদেশ হওয়া অভিবাসীদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করাসহ ভিন্নমতের কারণে মার্কিন অভিবাসনের আশ্রয় নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ পর্যন্ত এসব উদ্যোগ নির্বাহী আদেশের মধ্যেই সীমিত রয়েছে।

ক্ষমতা গ্রহণের ৪০ দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এসব উদ্যোগ অভিবাসন নিয়ে বিরাজমান পাহাড়সম সমস্যার কোনো সমাধান এনে দেয়নি। তবে অভিবাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। তিনি নির্বাহী আদেশ দিয়ে এসব সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারবেন না। নির্বাহী আদেশে অভিবাসীরা কিছু সুযোগ পেলেও তা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট এসে সহজেই বাতিল করে দিতে পারবেন। নির্বাহী আদেশগুলো নিয়ে রক্ষণশীল রাজ্যগুলো থেকে মামলা করেও এসব উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হারের পর প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় অভিবাসন বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের উদারনীতিকে আক্রমণ করেছেন। ফ্লোরিডায় রক্ষণশীলদের সমাবেশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের ছেলে ট্রাম্প জুনিয়রসহ অন্যরা একই সুরে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, বাইডেন ক্ষমতায় এসেই সীমান্ত খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন দলে দলে মানুষ সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকবে। এতে মার্কিন অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। মার্কিন লোকজন চাকরি পাবে না। নানা পথে এ দেশে এসে কর্মবাজারে অল্প মজুরিতে কাজ করবে অভিবাসীরা। স্কুল, হাসপাতাল ভর্তি হয়ে যাবে। আইনলঙ্ঘন করে আসা এসব মানুষ এ দেশের জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠবে।

রক্ষণশীলদের এই অভিবাসন বিরোধিতা সাধারণ শ্বেতাঙ্গরাও সমর্থন করে। ইউরোপের নানা দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে এখন অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক দল অভিবাসীবান্ধব হলেও সর্বক্ষেত্রে আমেরিকায় এখন অভিবাসীরা রাজনৈতিক চালের শিকার হচ্ছেন।

ডেমোক্রেটিক দলের যেসব আইনপ্রণেতা কিছুটা রক্ষণশীল এলাকার, তারাও অভিবাসন সংস্কার নিয়ে উদারনৈতিক অবস্থানে নেই। জো বাইডেন এর মধ্যেই কংগ্রেসকে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। নিউজার্সির ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান বব ম্যানেনডেজ এর মধ্যেই অভিবাসন আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন। কংগ্রেস ও সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। নিজেদের সব আইন প্রণেতাকে বাইডেন ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও ডেমোক্রেটিক দলের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে সংবাদমাধ্যম পলিটিকো এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমন্বিত অভিবাসন সংস্কার নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রস্তাবিত আইনের পক্ষে পর্যাপ্ত সমর্থন নেই। ফলে প্রতিনিধি পরিষদেরই আইন প্রস্তাবটি থমকে দাঁড়াবে।

অ্যারিজোনা থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান টম ও’ হেলারেন বলেন, কিছু আইনপ্রণেতা মিলে আইনের খসড়া করেছেন। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আরও বেশি আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত আইন এখনই কংগ্রেসে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত নয়।

কংগ্রেসওম্যান প্রমীলা জয়াপাল বলেন, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিনিধি পরিষদে সমন্বিত আইন প্রস্তাবটি উপস্থাপন করার জোর চেষ্টা চলছে। তাঁর মতো অতি উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরপরই সমন্বিত অভিবাসন সংস্কার আইন পাশ করলে জয় জয় অবস্থা বিরাজ করবে।

২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অভিবাসী গ্রুপগুলোর ব্যাপক সমর্থন না থাকলে ডেমোক্র্যাটরা বিপাকে পড়তে পারে। যদিও দলের মধ্যেই এখন বলা হচ্ছে, কিছু কিছু অভিবাসীকে বৈধতা দেওয়ার আগে আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা দরকার। খসড়া আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনার কথাও বলছেন অনেকেই।

পূর্ণ বা আংশিকভাবে হলেও এপ্রিলের মধ্যে প্রস্তাবিত অভিবাসন আইন কংগ্রেসে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে ডেমোক্র্যাটরা। দলের মধ্যপন্থীরা বলছেন, অভিবাসীদের কাজ দেওয়ার আগে যাচাই করে নেওয়ার বিধি রাখতে হবে। উদারনৈতিক মহলের দাবি, ছোটখাটো অপরাধের রেকর্ড আছে, এমন ব্যক্তিদের অভিবাসন প্রক্রিয়া থেকে যেন বাদ দেওয়া না হয়। এসব নিয়ে ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যেই এখন বিতর্ক চলছে। তবে এ বিতর্ক প্রকাশ্য নয়।

অভিবাসন সংস্কার আইন কংগ্রেসে উপস্থাপন হলেই শুরু হবে প্রকাশ্য বিতর্ক। এ নিয়ে ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে মার্কিন সমাজ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময় অভিবাসন নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়েছিল। এই শতকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশসহ ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চেষ্টা করেও অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারে ব্যর্থ হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখনকার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এমন বাস্তবতায় রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অভিবাসন নিয়ে কোনো নাটকীয় সংস্কার করার চেষ্টা হয়তো করবেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হবেন, এ নিয়ে এখনো তাঁর সমর্থকেরা সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না।