অসাধারণ মেধাবী সন্তান শায়ান

বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে শায়ান

অনেক সময় কিছু কিছু বিষয় আমাদের সঙ্গে ঘটে যায় বা আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাই, যা অনাকাঙ্ক্ষিত-দুর্লভ।

তেমনি আনোয়ারা আনা আমান এবং তাহরিন আমান দম্পতির তিন সন্তানের একজন শায়ান আমান। শায়ান এই দম্পতির প্রথম ছেলে সন্তান। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে সে কুইন্সের পিএস-২১৯ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। আসছে সেপ্টেম্বরে সামিট প্রাইভেট মিডল স্কুলে ভর্তি হবে শায়ান।

মাত্র দুই বছর বয়সে শায়ানের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) ধরা পড়ে। এরপর পাঁচ বছর বয়সে যুক্ত হয় অ্যাটেনশন-ডিফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)।

অনেকের ধারণা, অটিজম এবং এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুরা কম কার্যকারিতা সম্পন্ন ও নিজেদের সামাজিক অবস্থান গঠনে ব্যর্থ হয়। এটা ভুল ধারণা। বরং তাদের এমন সব দক্ষতা ও ক্ষমতা থাকে, যা সাধারণদের মাঝেও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শায়ান এমনই এক অসাধারণ মেধাবী সন্তান।

১১ বছরের শায়ান আমান সংগীতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। দুই বছর বয়স থেকেই সে বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষায় গান গাইতে শুরু করে। মাত্র তিন বছর বয়সে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করে। লালন গীতি, দেশাত্মবোধক, নজরুল গীতি সবই তার আয়ত্তে। ইংলিশ ভয়েস লেসন, ভোকালিস্ট ট্রেনিং ও পিয়ানো বাজানোও শিখছে সে।

শায়ানের আরও একটি বিশেষ দিক হলো—তার পারফেক্ট পিচ বা সম্পূর্ণ পিচ। কোনো একটি রেফারেন্স পিচ ছাড়া অবিলম্বে একটি নির্দিষ্ট অস্তিত্বের গান শনাক্ত করা বা গাওয়ার মতো একটি বিরল ক্ষমতা হলো পারফেক্ট পিচ। অনুমান করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজারে একজন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়। শায়ান তাদেরই একজন।

ইউটিউবে শায়ানের কিছু ভিডিও চিত্র রয়েছে, যা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার হতে পারে। অটিজম সচেতনতার মাস এপ্রিলের ২৩ তারিখ ইউটিউব চ্যানেলে শায়ান ‘Autism is my superpower’ নামে একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। নিজের অটিজমকে জানতে, বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারা শায়ান ওই ভিডিও চিত্রে বলেছে, ‘It makes me different and different is the best thing that somebody could ever be!’ এ রকম আরও ভিডিও চিত্র শায়ানের রয়েছে যা সত্যি মনোমুগ্ধকর এবং অনুপ্রেরণামূলক।

শুধু শৈল্পিক গুনেই নয়, শায়ান পড়াশোনাতেও মেধাবী। তিন বছর বয়সে সে প্রথম শ্রেণির বই পড়ার দক্ষতা অর্জন করে। মাত্র ১৮ মাস বয়সে সে ২৫০টি শব্দ চিনতে পারত। স্কুলে পড়া এবং গণিতে উচ্চ কার্যকারিতা তার। বাড়িতেও প্রচুর বই পড়তে পছন্দ করে শায়ান। সে কারণে তার শব্দ ভান্ডার খুবই শক্তিশালী। শায়ান বন্ধুপরায়ণ, মিশুক এবং দায়িত্বশীল।

আনা আমান বলেন, ‘শায়ান শিখতে পছন্দ করে। প্রশ্ন করে করে শেখে সে।’ তিনি বলেন, শায়ান গান, অভিনয় ও মুভি খুব পছন্দ করে। অভিনয়ের জন্য ১৩০টি দেশ থেকে ১২০০ প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে ৩০০ বাচ্চাকে বাছাই করা হয়েছিল। নিউইয়র্ক থেকে ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে শায়ান নির্বাচিত হয়েছিল।

ভবিষ্যতে কী হতে চায় শায়ান—এই প্রশ্নে শায়ানের মা আনা আমান জানান, শায়ানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেক। প্রথমে সে সুরকার হতে চায়। তারপর অভিনেতা এবং সবশেষে মুভি মেকার হতে চায়।

শায়ানের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করা। বিশেষ করে বাংলাদেশ ভ্রমণ এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ তার। থিয়েটারে যেতে পছন্দ করে। তবে তার অপছন্দের দিকও আছে। পরীক্ষায় ফল একটু খারাপ হলে খুবই হতাশ হয়ে পড়ে সে। পরিবারের কাউকে হতাশ দেখতে পছন্দ করে না শায়ান। বিশেষ করে, মাকে সব সময় খুশি দেখতে চায়।

‘যেকোনো বিষয় বা ঘটনাকে শায়ান গভীর দৃষ্টিতে দেখে। কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেওয়ার আগে সে অন্তর্নিহিত কারণ খতিয়ে দেখে। অনেক সময় তার চিন্তা-ভাবনা থেকেও আমি শিখি।’

শায়ানকে নিয়ে তার বাবা-মা গর্বিত। একজন অটিস্টিক এবং এডিএইচডিতে আক্রান্ত শিশু স্বাভাবিকভাবে যেসব আচরণগত সমস্যার সম্মুখীন হয়, শায়ানকে তা মোকাবিলা করতে হয়নি। সমস্যা বলতে, মাঝে মাঝে সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। পাঠে পারদর্শী হলেও, লেখার ক্ষেত্রে একটু অগোছালো।

তবে শায়ানের দৃষ্টিভঙ্গি খুব সচেতন বলে মনে করেন তার মা। আনা আমান বলেন, ‘যেকোনো বিষয় বা ঘটনাকে শায়ান গভীর দৃষ্টিতে দেখে। কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেওয়ার আগে সে অন্তর্নিহিত কারণ খতিয়ে দেখে। অনেক সময় তার চিন্তা-ভাবনা থেকেও আমি শিখি।’

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে আনা আমান এবং তাহরিন আমান নিজেদের প্রচেষ্টায় ‘চাইল্ড ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি, অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী কল্যাণ সংস্থা পরিচালনা করে আসছেন। চাইল্ড ফাউন্ডেশন ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ বিষয়ে আনা আনাম বলেন, ‘আমরা এটি শুরু করেছি কারণ আমরা নিজেদের বাচ্চাটিকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, অটিজম, এডিএইচডি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমরা আমাদের সন্তানকে ভালোবাসি।’

কুইন্সের বেলরোজে বাস করা আনা আমান ও তাহরিন আমান দম্পতির মতো সব বাবা-মা যেন নিজ সন্তানের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সবকিছুর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রেখে দায়িত্বের সঙ্গে সামনে এগোতে পারি, এই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, অটিজম কোনো অক্ষমতা নয়, বরং সক্ষমতার আরেকটি দিক।