আড্ডার স্মৃতি

হোয়াইট হাউসের সামনে ভ্রমণ দলের সদস্যরা

ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার কিছু আলোকিত পাঠক-লেখকের সমাজ আছে। তাঁদের সঙ্গে একটা আড্ডার পরিকল্পনা বেশ আগে থেকে তৈরি হয়ে আছে। কথা ছিল, অতিমারি স্বাভাবিক হয়ে আসলেই আমরা রাজধানীর মানুষের কাছে যাব আগে।

অফিসে নানা কাজ সামাল দিয়ে বিকেল চারটায় ফ্রি হয়ে গেলাম। রওনা দিলাম নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড থেকে জ্যাকসন হাইটসের উদ্দেশ্য। সেখান থেকে রহমান মাহবুবসহ নিউজার্সি। লং আইল্যান্ড ফারমিংডেল থেকে জ্যাকসন হাইটসে পৌঁছাতে কোনো রকম ট্রাফিক ছাড়াই এক দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! আমার স্বামী (রানা) গাড়ি চালু করার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় গাড়ির গতি স্লো হয়ে যায় এমন আবহাওয়ায়। রাগ হচ্ছিল, পারলে পায়ে হেঁটে রওনা দিই।

ধীর গতিতে গাড়ি চলছে। এর মাঝে আমাদের দলনেতা লোকেশন জানার জন্য বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন। মোবাইল মিউট করে রেখেছিলাম অফিসে। এরপর আর মোবাইলের কথা মনে ছিল না। রানার মোবাইলে কল আসায় বুঝতে পারলাম, কী হতে যাচ্ছে। আমার একজনের কারণে সবার দেরি হয়ে যাবে।

বৃষ্টি হবে আর রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হবে না, এমন সুদিন আশা করার কোনো অবকাশ নেই। তিনটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট পেরিয়ে গাড়ি জ্যাকসন হাইটস পৌঁছাতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়।

রহমান মাহবুব আর তোফাজ্জল লিটন ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন। লজ্জা পেয়ে গেলাম, নিজের কাজের জন্য। এই শহরের সবাই যখন আনএমপ্লয়মেন্ট খায়। আমি তখন ধুম কাজে ব্যস্ত। আমার কপালে সরকারের কোনো মহামারি ভাতা জোটেনি। তাই যাই করি অফিস শেষে করতে হয়। রহমান মাহবুবের দামি ঝকঝকে গাড়ি। কথা হয়, দলনেতা ইব্রাহীম চৌধুরীর বাসায় ভাত খাব। না হয়, সেখানে অবস্থান ধর্মঘট করব।

হাসি ঠাট্টা আর গানে গানে নিউজার্সি পৌঁছাতেই রাত আটটার বেশি হয়ে যায়। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে জীবনে কোথাও যাইনি। সময়ের অভাবে খাওয়ার কথা ভুলে গেলাম। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি বদলে নিয়ে দলনেতা গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

চমৎকার ড্রাইভিং। তবে সমস্যা ছিল একটু পর পর গাড়ির তেল নেওয়ার মতো ড্রাইভারের পান খাওয়া। গাড়ি দ্রুত গতিতে ডিসির দিকে ছুটে চলছে। ভাবছিলাম ননস্টপ চললেও রাত ১২টা বেজে যাবে। এর মধ্যেই ফ্লোরা ভাবি আমার দিকে কলা এবং ক্রোসান্ট এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি কাজ থেকে এসেছ, এগুলো খাও। সামনেই আমরা সবাই থেমে কিছু খাব।

দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বন্ধুদের নিয়ে ডিসি ট্যুরে অনেকবার যাওয়া হয়েছে। তাই এই শহর অনেকটাই চেনা। উত্তর আমেরিকার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহর। ওয়াশিংটন শহরটি কোনো মার্কিন অঙ্গরাজ্যের অংশ নয়। এটি ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া নামক একটি বিশেষ কেন্দ্রশাসিত জেলাতে অবস্থিত। শহরটি পটোম্যাক নদীর তীরে মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ার মাঝে অবস্থিত। ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া আর মেরিল্যান্ড দিয়ে প্রবাহিত পটোম্যাক নদী নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান। লিখেছেন বিখ্যাত সব কবিরা।

যাত্রাপথে বাথরুম আর খাবার বিরতি নিয়ে দ্রুত গাড়ি ছুটছে। বেশি সময় লাগেনি স্প্রিংফিল্ড, ভার্জিনিয়ায় উইনগেট হোটেলে পৌঁছাতে। সবার জন্য আলাদা রুম থাকা সত্ত্বেও আমি ভাবি আর রোকেয়া দীপা এক রুমে। একা থাকায় কোনো আনন্দ নেই, তাই সঙ্গ দোষে দোষী হলে তাতে রাজি। রাত ভোর হতে অল্প বাকি।

আজ ঘুমাব না। আজ শুধুই আনন্দের দিন। সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে গেছি। নিউইয়র্ক থেকে মনজুরুল হক আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে গিয়েছেন রাতের খাবার, স্পেশাল বিরিয়ানি। আমার রুমে ইতিমধ্যেই অন্য সঙ্গীরাও চলে এসেছেন। বিরিয়ানির গন্ধে এসেছেন নাকি আমার জেগে থাকার মনের জাদুতে তাঁরাও জেগে উঠেছেন বুঝতে পারার আগেই খাবার খাওয়া শেষ।

খাবার পরে গান। গানে গলা মিলিয়ে থেমে থাকার মতো মানুষ আমি নই। গান যেমনই হোক, নয়া দামান গানের সঙ্গে ধামালি দিতে পেরে অনেক খুশি হলাম। কেউ লাইভ করে, কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত হলেও তাও আনন্দময়। তারপর বেরিয়ে গেলাম রাতের ভার্জিনিয়া দেখতে।

গ্রুপে গেলে নিজের কোনো পছন্দ থাকে না। দলনেতা নিয়ে গেলেন এমজিএম ক্যাসিনোতে। দেখে বের হতে হতে সকাল হয়েছে। এরপর হোটেলে ফিরে পছন্দের শাড়ি পরে নাশতা সেরে বেরিয়ে গেলাম ডিসি পরিদর্শনে।

কারও চেহারায় এক ফোঁটা ক্লান্তি ভাব নেই। গাড়ি পার্ক করে যেন একদল পথিক বেরিয়ে পড়েছি ওয়াশিংটন ডিসির বিখ্যাত স্থানগুলো পরিদর্শন করতে। হেঁটে যতটুকু সম্ভব দেখা হয়েছে—হোয়াইট হাউস, লিংকন মেমোরিয়াল, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার মেমোরিয়াল, জেফারসন মেমোরিয়াল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট ও ক্যাপিটল হিল।

দেখা হলো মানবাধিকার কর্মী ফিলিপসের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে হোয়াইট হাউসের সামনে বসে আছেন। অহিংস আন্দোলনের দাবি চালিয়ে হতাশ না হওয়ার জন্য সারা বিশ্বের মুক্তিকামী লড়াকু মানুষের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন ফিলিপস। তিনি ফ্রি প্যালেস্টাইন ব্যানার ফেস্টুন ধরে আছেন সেই সাদা বাড়িটার সামনে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি আর অনির্বাণ খন্দকার ক্লান্তিহীন ছবি তুলেই যাচ্ছেন।

কত মাইল হেঁটেছি গুনে দেখা হয়নি। তবে দুপুরে খাবার খেয়ে মনে হলো, জীবনের সেরা খাবারটি খেয়েছি। এরই মধ্যে সময় হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। যে কারণে এখানে আসা। হাডসন, র‍্যারিটন পাড় থেকে পটোম্যাক তীরের অগ্রসর লোকজনদের নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পাঠক-লেখক-সাংবাদিক ভ্রাম্যমাণ আড্ডা। আয়োজন করেছেন এই অঞ্চলের কিছু মেধাবী ও তারকা লেখক।

দুপুরের খাবার শেষ হতেই কল দিলেন বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদ। মহান মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসক বীর প্রতীকদের একজন। জীবনযুদ্ধে এখনো হার না মানা এ সৈনিককে কাছে পেয়ে খুশিতে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চোখ ভিজে আসে। যুদ্ধে দুইবার গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া আমাদের কৃতি সন্তান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো হাঁটুতে যুদ্ধের আঘাতের কষ্ট বয়ে বেড়ান। দেশের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। আক্ষেপ করে বলেন, এমন দেশ তো আমরা চাইনি। যুদ্ধে গুলি লাগা হাঁটুর ব্যথার জন্য বেশি সময় বসতে পারেন না বলে সবাইকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলেন।

এরপর শুরু হয় মূল আড্ডা। হাসি ঠাট্টার মাঝেই খুবই সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। সমস্যা হলো এত ক্ষুধা কোথা থেকে আসল কে জানে? অল্প আগে দুপুরে খাবার খেয়েও পেট ভরে ছোলা মুড়ি সমুচা ও সুবীর ভাইয়ের শ্রীমঙ্গলের চা খেতে খেতে অনেক ছবি তোলা হলো। রাতের খাবারের পর্ব মানে খানার পর খানা। সবাই মিলে চলে গেলাম একটি দেশি খাবারের রেস্তোরাঁয়, আর্লিংটনের কাবাব কিং রেস্টুরেন্টে। আবাসন ব্যবসায়ী নাজির উল্লাহ ভাইয়ের আমন্ত্রণে আরেক দফা অনেকের সঙ্গে রাতের খাবারের টেবিলে দেখা হয়ে গেল। ছেলেরা যেমন মেয়েদের হাসি দেখে প্রেমে পড়ে। আমি লক্ষ্য করলাম, নিজের অজান্তেই আমার চোখ বারবার মোস্তফা তানিম ভাইয়ের হাসিতে আটকে যাচ্ছে। আশীফ এন্তাজ রবি ভাইয়ের জোক শুনব নাকি তানিম ভাইয়ের হাসি দেখব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ দুজনেই আমার সামনে বসা। এই ফাঁকে রবি ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ভাইরাল হওয়ার মতো ছবি তুলে ফেলেছি। এত এত ছবির ভিড়ে সেই ছবিটা পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এক ফাঁকে আনোয়ার ইকবাল ভাই এসে বলে গেলেন, আমাকে সুন্দর সিলেটি বলতে শুনেছেন। সব কথার শেষ কথা ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়ায় আমাদের এবারের এ ভ্রমণটি মূলত ইব্রাহীম চৌধুরীর ‘মহামারি করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’ বইটি নিয়ে। নিউইয়র্কের করোনাকালীন ইতিবৃত্ত নিয়ে আমার লেখা বেশ কিছু প্রতিবেদন রয়েছে বইটিতে। এখানকার বাংলাভাষী মানুষের সঙ্গে বইটির পরিচয় করিয়ে দিতে, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হতে আমাদের এই ভ্রমণ প্রয়াসটি শতভাগ সফল হয়েছে।