আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস ও কিছু ভাবনা

১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। জাতিসংঘ ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঘোষণা করে যে, প্রতি বছর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এখানে সংখ্যালঘু বলতে জাতিসংঘ বলেছে, ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত ও সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের বুঝিয়েছে।
জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ নিজের ভূখণ্ডের সীমার মধ্যে ধর্মীয়, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত, সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে রক্ষা করবে এবং তাদের পরিচিতির প্রকাশ ও উন্নয়ন ঘটাতে উৎসাহ দান করবে। বহু আগেই জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলা হয়। জাতিসংঘ তার মানবাধিকার সনদের ৩০ নম্বর ধারায় এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির ২৭ নম্বর ধারায় ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগোষ্ঠীগত ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগণের অধিকারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কথা বলেছে।
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য হলো আমাদের দেশের মর্মবাণী। সংখ্যাগুরু মুসলিম ছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, পাহাড়ি ও অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীরাও রয়েছে আমাদের দেশে। বাংলা ভাষা সমগ্র জাতি ও রাষ্ট্রের প্রধান ভাষা হলেও নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। যদিও সেগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। অন্যদিকে দুঃখের বিষয় হলো সরকার জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আদিবাসী অধিকার’ অস্বীকার করে আসছে।
গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এই ভিত্তিটাই আজ আক্রান্ত। সংবিধানে নির্দিষ্ট একটি ধর্মকে স্থান দিয়ে সব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বিত অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। এতে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃ-গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসারে উৎসাহ জুগিয়েছে। ফলে সমগ্র দেশে সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি, সহাবস্থান ও সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশ হুমকির মুখোমুখি। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নৃ-গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, জবরদখল ও সহাবস্থানের জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অথচ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এমন একটি দেশ, যার জন্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই বড় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। দুই দলই সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সবার সহাবস্থান ও সমানাধিকারের বাংলাদেশে এই প্রতিশ্রুতি প্রশ্নের উদ্রেক করে।
জনমুখী উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হলো শান্তি, সম্প্রীতি ও সব অংশের জনগণের ঐক্য ও তাদের অংশগ্রহণ। সেই ভিত্তিটাই আজ নড়বড়ে। এই পটুভূমিতেই এই দিনটি বর্তমানে আমাদের দেশে পালনের কথা ভাবতে হবে। শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা অনুপ্রবেশের চক্রান্ত চলছে। গত দুই দশকে দেশে সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নৃ-গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বেড়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় দেশত্যাগ করায় তাদের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এ ঘটনা বাঙালি সংস্কৃতি গঠন ও সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হুমকির কারণ। শাসকদলের সঙ্গে মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগ থাকায় সাম্প্রদায়িক শক্তি বাড়তি রসদ পাচ্ছে। ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্রমবর্ধমান উসকানির মুখে সংখ্যালঘু অধিকার খর্বিত হচ্ছে।
তাই আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবসের ভাবনার সঙ্গে ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিপদটিকেও অনুধাবন করতে হবে। কোনো ধর্মেই সন্ত্রাসবাদে মান্যতা নেই। আসলে সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের স্বার্থ ধর্ম নয়, ধর্মাতিরিক্ত। তাই আজকের দিনের ভাবনা হোক সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্যকে শক্তিশালী করা। ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন তখনই মজবুত হবে, যখন রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে বাড়তি পৃষ্ঠপোষকতা করবে না।