আমার ডিভি লটারি ও আমেরিকান ড্রিম

আমেরিকা আসার আগেই আমেরিকার টেক্সাস, মিশিগান ও নিউইয়র্কে আমার পরিচিত কিছু মানুষজন ছিলেন। আমি ২০০৪ সালে ডাইভার্সিটি ভিসা (ডিভি) নিয়ে আমেরিকায় আসি। প্রথমে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে এক বড় ভাইয়ের বন্ধুর বাসায় উঠি। এক সপ্তাহ সেখানে থেকে শেয়ারে রুমমেট হিসেবে অন্যত্র চলে যাই। আমেরিকায় যারা ইমিগ্রান্ট হয়ে আসেন, তাঁদের শুরুর জীবন খুব কষ্টের। থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই কষ্ট। নিজের ভাই-বোন থাকলে কিছুদিন একটা সাপোর্ট পাওয়া যায়, না থাকলে পড়তে হয় বিপদের মহাসমুদ্রে।

উড়োজাহাজ থেকে আমেরিকার টেক্সাসে যখন নামি, তখন আমার ধারণা ছিল এক রকম; ভাবলাম ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, চাকরি একটা হয়ে যাবে। কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝলাম, ‘অড জব’ করতে চাইলেও চাই অভিজ্ঞতা, দরকার কারও না কারও রেফারেন্স। মহা বিপদে পড়লাম। কী করব, কিছু বুঝতে পারছি না। রুমমেটরা গ্যাস স্টেশনে কাজ করে। তারাও খুব একটা আগ্রহ দেখাল সেখানে কাজ খুঁজে দেওয়ার বিষয়ে। কিন্তু যে করেই হোক, আমার সারভাইবের জন্য একটা ‘অড জব’ হলেও কিছু একটা চই। সবচেয়ে বড় সমস্যা গাড়ি। চালাতে জানি না, গাড়ি কেনার পয়সাও নেই। আমি আসার পর তৃতীয় সপ্তাহে দেশে আমার আব্বা মারা যান। খুব আপসেট ছিলাম অনেক দিন। কিন্তু জীবন জীবনের মতো চলবে—এটাই স্বাভাবিক।

আমার এক ফুপু, আব্বার ফুপাতো বোন মিশিগানে থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হতো। তাঁকে সমস্যার কথা বলতাম। কথায় কথায় তিনি আমাকে তাঁর এক আত্মীয়র মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন; বললাম, ‘এখন সম্ভব না।’ এরপর থেকে তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর মেয়ে, মানে আমার ফুপাতো বোন ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে স্বামী-সংসারের কথা চিন্তা করে আর করপোরেট চাকরিতে যাননি। স্কুলশিক্ষক হিসেবেই বেশ স্বচ্ছন্দের সঙ্গে এক হালি বাচ্চা-কাচ্চা, স্বামী-সংসার নিয়ে থাকতেন। তিনিও আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘করপোরেট চাকরিতে এখানে হায়ার-ফায়ার খুব নরমাল।’ তাই পড়াশোনার পাশাপাশি ফার্মাসি টেকনিশিয়ান ধরনের ছোট-খাটো কোর্স করার অনুরোধ করলেন।

দেশের এক পরিচিত লোককে জানতাম, যিনি টেক্সাসে ফাস্টফুড দোকানের ম্যানেজার। বেশ কাছের মানুষ বলা যায়। টেক্সাসে তাঁর ফোন নম্বর জানতাম না। একে-তাকে বলে তাঁর নম্বর জোগাড় করলাম। ফোন দিলে তিনি একদিন বাসায় যেতে বললেন। বললাম, গাড়ি নেই। পরে ছেলেকে পাঠিয়ে আমাকে নেওয়ালেন তাঁর বাসায়। সারা দিন সেখানে কাটালাম। বললেন, ‘তোমার থাকার কষ্ট। একটা বিয়ে করে ফেল।’ বললাম, ‘নিজের যা রোজগার, কাজকাম নেই, আবার বিয়ে!’ যা হোক তিনি বুঝলেন যে, আমি এতে রাজি না। বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থেকে পড়াশোনা চাকরি করে আয় করার মানুষ আমি না।

আমার আরেক পরিচিত বোন থাকতেন নিউইয়র্কে। তাঁর সঙ্গেও ফোনালাপ হতো প্রায়ই। গাড়ি নেই শুনে বললেন, ‘নিউইয়র্কে চলে এস; একটা না একটা ব্যবস্থা হবে।’ তাঁর স্বামী জেএফকে বিমানবন্দরে একটি এয়ারলাইনসের এভিওনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বললেন, ‘নিউইয়র্কে চলে এস। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন আছে। এখানে-সেখানে যেতে পারবে। গাড়ি না থাকলেও সমস্যা নেই।’ আমার পরিচিত বোন দুই বাচ্চা, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ব্যস্ত। নিউইয়র্কে গিয়ে কোথায় থাকব, কী করব ভাবতে লাগলাম। শেষে কিছুদিন পর বোনের স্বামীকে বললাম, ‘আমাকে কারও সঙ্গে শেয়ারে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।’ তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। টেক্সাস থেকে তিন মাসের মাথায় নিউইয়র্কে চলে এলাম, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জ্যাকসন হাইটসের বাঙালি পাড়া দেখে মনে হলো বাংলাদেশের কোনো এক মহল্লায় আছি! জানে পানি এল। খুব ভালো লাগা শুরু হলো নিউইয়র্কে!

ট্রেনে চড়ে এদিক-সেদিক গিয়ে ‘অড জব’ খোঁজা শুরু করলাম। পরিচিত একজনের মাধ্যমে একটি রেস্তোরাঁয় হোস্টের চাকরি পেলাম। একসঙ্গে দুটি ‘অড জব’ করতাম। ঘুমাতাম মাত্র ৪ ঘণ্টা। অনেকের হয়তো বিশ্বাস হবে না! কিন্তু এটাই সত্যি। হায়ার-ফায়ারের কথা চিন্তা করে সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কে ভর্তি হলাম ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। আমার ব্যাচেলর ছিল কম্পিউটার সায়েন্সে মেজর। ক্লাস শুরুর পর একটি ‘অড জব’ ছেড়ে দিলাম। কারণ, ফুলটাইম স্টাডির সঙ্গে দুটি চাকরি সম্ভব নয়।

স্কুলে ভারতীয় বাঙালি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেলামেশা হলো। গ্রুপ স্টাডিতে হায়দরাবাদের এক ছাত্র কথায় কথায় জানল, আমার গ্রিনকার্ড আছে। জানতে চাইল, ব্যাচেলরে আমার মেজর কী? বললাম, কম্পিউটার সায়েন্স। বলল, ‘মাস্টার্স করা লাগবে না। যেহেতু গ্রিনকার্ড আছে, তুমি আইটি কনসালটিং শুরু করতে পার প্রশিক্ষণ নিয়ে।’ আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম! শুনেছি এ দেশের ডিগ্রি ছাড়া কোনো চাকরি হয় না। আর এই ছেলে সেমিস্টারের মাঝে বলছে, আইটি ট্রেইনিং করে আইটি কনসালটিং করতে! বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু সেমিস্টার শেষে একটা সিদ্ধান্ত নেব বলে ঠিক করি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে?’ ওর পরিচিত একটা কনসালটিং কোম্পানির নাম দিল। সেমিস্টার শেষে আইটি ট্রেইনিং করলাম। কনসালটিং কোম্পানি ট্রেইনিং শেষে প্লেসমেন্ট করল। ডেটা ইন্টিগ্রেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে। শুরু হলো প্রফেশনাল লাইফের আইটি কনসালটিং।

আজ বোস্টন, কাল টেক্সাস, পরশু শিকাগো কিংবা কানাডা—এভাবে আইটি কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে থাকলাম। কিন্তু কিছুদিন পর মনে হলো, এভাবে আর কত দিন! কোনো পারমানেন্ট চাকরি নেই; কামলাদের মতো কন্ট্রাক্ট। যা হোক, সৌভাগ্যবশত একটা ফেডারেল প্রজেক্টে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে আইটি কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ পেলাম। পাশাপাশি ফেডারেল জবের জন্য আবেদন করতে লাগলাম। বছর দু-এক পর ফেডারেল ওই একই এজেন্সি থেকে আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকল। গেলাম, ইন্টারভিউ দিলাম। ইন্টারভিউ শেষে হায়ারিং ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই পজিশনে আমি রাজি কিনা? আগে-পিছে কিছু চিন্তা না করে এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। কিছুদিনেই আমার জব অফারের কনফারমেশন এল ই-মেইলে। সেই চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আবার পার্ট টাইমে মাস্টার্স পর্ব শুরু করলাম।

চাকরিতে থাকতে থাকতেই মাস্টার্স শেষ করলাম। ম্যারিল্যান্ডের এজেন্সিতে চার বছর কাজ করার পর প্রমোশনাল জব নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াতে আরেক এজেন্সিতে যোগ দিলাম।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, আমেরিকাতে ইমিগ্রান্টদের হয়ে যারা সপরিবারে আসেন, তাঁরা সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন। এখানে জীবন-জীবিকার শুরুটা অত্যন্ত কষ্টের বলা যায়। ‘অড জব’ দিয়ে শুরু হয় এখানে। দেশের কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের কেউ হলে অন্য কথা। কিন্তু তারপরও কিছু না কিছু করতে হয়। দেশ থেকে টাকা এনে দেশের রাজকীয় হাল হকিকতে থাকা এ দেশে সম্ভব নয়—এটি আমাদের দেশের উচ্চবিত্তবানরাও বোঝেন।

ইমিগ্রান্টরা, যারা তরুণ, তাঁরা পড়াশোনা করে ডিগ্রি লাভের পর পেশাদার চাকরির চেষ্টা করতে পারেন। পড়াশোনা করার সময় গ্রীষ্মের ছুটিতে ইন্টার্নশিপ করলে পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়া সহজ হয়। কিন্তু পরিবার-পরিজন থাকলে পড়াশোনা করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। তখন সংসার চালানোই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও চেষ্টা করতে হয়, করে যেতে হয়। ইমিগ্রান্ট, যারা আমেরিকায় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন, তাঁরা কনসালটিং কোম্পানির মাধ্যমে চাকরি খুঁজে নিতে পারেন, অথবা আমার মতো যাদের দেশ থেকেই কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি রয়েছে, তাঁরা আইটি প্রশিক্ষণ নিয়ে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরুর চেষ্টা করতে পারেন।

আমার অনেক পরিচিতজন আছেন, যারা উচ্চশিক্ষিত হলেও এখানে এসে তেমন কিছু করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে আমি খুব ভাগ্যবান। এ দেশে আমি এসেছিলাম একা। তাই সম্ভবত এত দূর যেতে পেরেছি নিজ চেষ্টায়, কঠিন শ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে।

আমার স্ত্রীও দেশে চিকিৎসক ছিলেন। ইউএসএমএলই সম্পন্ন করেও রেসিডেন্সিতে চান্স পাননি। যখন আমার স্ত্রীর চাকরি হচ্ছিল না, তখন আমি তাঁকে আমার শুরুর কষ্টের গল্প শোনাতাম। সে বলত, হয়তো সে আমার মতো কষ্ট করেনি বলেই তার কোনো গতি হচ্ছে না। অবশেষে বিভিন্ন জায়গায় চার বছর বিনা পয়সায় ‘ভলান্টিয়ার রিসার্চ ওয়ার্ক’ করে শেষে একটি স্বনামধন্য মেডিকেল রিসার্চ অর্গানাইজেশনে চাকরি পেয়ে যায়।

আমেরিকার জীবন যে কত কষ্টের সেটি বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ অনুধাবন করতে পারে না। তারা মনে করে, আমেরিকা মানেই চাকরি, আর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার। কিন্তু বাস্তবে জীবন এখানে খুব কঠিন। ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকাতে এসেছিলাম। সব রকম কষ্ট করে ফেডারেল সরকারের উচ্চপদে সম্মানজনক পেশায় কাজ করছি এখন—এটাই আমার আমেরিকান ড্রিম!