প্রতিবার বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যায়, আর লেখা হয় না। বাবা ছিলেন আমার বন্ধু, আমার আদর্শ ও আমার অনুপ্রেরণা। সবার কাছেই নিজের বাবা-মায়ের আদর্শটা প্রধান থাকে। যদিও পরিবারে ভাইবোন সবার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান আমার অনেক। আমার বড় বোনের বিয়ে হয় যখন, তখন আমার বয়স নয় মাস। তাই যৌবনে বাবার স্মৃতি আমার কাছে নেই। তবে আমার দেখা বাবার অনেক গুনের মধ্যে, কিছু কথা আজ লিখব।
আমাদের বাড়িতে কাচ ও কাঠের কারুকাজ মিশ্রিত বিরাট দুটো আলমারি ছিল। দুটিতেই মায়ের শখের বাসন সাজানো ছিল। মায়ের আলমারি তালা দেওয়া থাকত, এ জন্য যদি কেউ তোলা বাসন নিতে গিয়ে ভেঙে ফেলে। তবে শুনেছি ঘটেছিলও এ রকম ঘটনা অতীতে। তাই মায়ের আলমারি দরকারে, মা নিজেই খুলে নিজের হাতে অতি সাবধানে বাসন নিতেন। আমার মায়ের নেশা ছিল সুন্দর সুন্দর বাসন কেনা ও আলমারিতে সাজিয়ে রাখা। বিশেষ বিশেষ দিনে এই তোলা বাসনগুলো যেমন ঈদের দিন ও নতুন কুটুম আসলে ব্যবহার হতো।
বাবার আলমারিতেও বাসন ছিল, তবে কিছু অংশে বাবার কিছু দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসও ছিল। সেই সুবাদে, বাসন ভাঙার আশঙ্কা ছিল না। তাই বাবার আলমারিটা সবাই খোলার সাহস পেতাম। বাবার আলমারিতে কাগজ, মানিব্যাগ ছাড়া ছিল একটা কাচের সুগার পট। সেই সুগার পটে বাবা আমাদের সবার দৈনন্দিন খরচের টাকা রাখতেন। বাটিটি ছিল আমার মায়ের বিয়ের টি-সেটের সঙ্গের সুগার পট। পুরোনো দিনের সুগার পট, তাই গোলগাল বেশ বড়ই ছিল। সুগার পটে স্কুল কলেজের রিকশা ভাড়া, এ ছাড়া ফকিরকে ভিক্ষার পয়সা, বৃষ্টির দিন বা স্কুল বন্ধ থাকলে বাদাম খাওয়া, মোটামুটি ছোটখাটো অনেক কিছুই হতো। যাকে আমরা ভাই-বোন, মা-বাবা সবাই টাকার বাটি বলতাম।
জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি, এই টাকার বাটি। এই বাটিতে সব সময়ই টাকা থাকত, কখনো বাটিটা শূন্য দেখিনি। মনে আছে, ছোটবেলা একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আব্বা এই টাকার বাটির টাকা কেন শেষ হয় না?’ আব্বা সেদিন হেসে বলেছিলেন, ‘আমি চাই না, তোমরা কেউ আমার কাছের প্রতিদিন টাকা চাও, যার যখন টাকা দরকার হবে, এই বাটি থেকেই নেবে। এই বাটিতে তোমাদের দৈনন্দিন খরচের টাকা।’ বাবাকে আমরা আব্বা বলতাম, আব্বার কথাটা তখন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি, আব্বা সেই ছোটবেলা থেকেই কত বড় শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন। টাকা পয়সা চাইতে হয় না, চাইলে অভ্যাস হয়ে যায়। আবার চোখের সামনে টাকাপয়সা থাকলে লোভও থাকে না। এমন নয়, আমার বাবা খুব ধনী বা টাকাওয়ালা ছিলেন।
বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন, তারপরও সীমিত আয়ের সংসারে সবকিছুই পেয়েছি। বাবা খুব নিয়ম মেনে চলতেন, সবার সব ছোট ছোট জিনিসের খেয়ালও বাবা রাখতেন। কারও ঘরে পরা স্পঞ্জের সেন্ডেল ছিঁড়ে গেলেও বাবার খেয়াল করতেন। মাস শেষে সবার সব দরকারি জিনিস আমরা পেয়ে যেতাম। কারও কখনো কিছু বলতে হয়নি, আদর আহ্লাদে বাবা-মায়ের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকতাম। বাবার সঙ্গে দাবা খেলা ও পত্রিকায় যে কুইজ থাকত তা নিয়ে খেলা। এমনকি আমার জ্বর হলে বাবা কোলে নিয়ে হাঁটাতেন সারা রাত, আজও চোখে ভাসে। খেতে না পারলে, বাবা খাইয়ে দিতেন নিজ হাতে।
ভাই-বোন বেশি থাকায় বাবা মাকে সংসারের প্রতিটি কাজে খুব সাহায্য করতেন। আমাদের কারও মাঝে চাকচিক্যের অভ্যাস ছিল না। এমনকি আমার বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন পর্যন্ত আমাকে হাত খরচের টাকাও দিতেন। বিয়ের পর টাকা নিতে মানা করলে, নানা অজুহাতে টাকা দিতেন। আব্বা বলতেন, ‘আরে তুমি এত সুন্দর করে পাতাবাহার গাছ দিয়ে ঘর সাজিয়েছ, তাই এটা তোমার পুরস্কার।’ আমার নিজের কাজের টাকা বা স্বামীর টাকা সত্ত্বেও তিনি সামান্য কিছু দিয়ে শান্তি পেতেন। আব্বা জানতেন, তার মেয়ে টাকার দরকার হলে কখনো জামাইয়ের কাছে চাইবে না। এটা খুবই সত্য, আমি কখনো চাইতে পারি না। আমাদের ভাই-বোন সবাই প্রচণ্ড আত্মনির্ভরশীল ও সব কাজের কাজী।
আমাদের বাড়িতে মিস্ত্রি খুব কমই দেখেছি। ছোট ছোট কাজ যেমন মুরগির ঘর, হাঁসের ঘর, কবুতরের বাসা, অল্পস্বল্প রঙের কাজ, সামান্য কিছু ইলেকট্রিকের কাজ, আব্বা শুরু করতেন আর বাড়ির সবাই মিলে শেষ করতেন। বাবা বলতেন, ‘সব কাজেই অল্প-স্বল্প জ্ঞান রাখো, জীবনে কখন কী কাজে আসে।’ ছেলেমেয়ে বিষয় ছিল না, বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে সবাই সব কাজ করতেন। এখনো মনে আছে, ঈদের আগের রাত আম্মা রান্না করতে ব্যস্ত আর আব্বা ঘরের ধোয়া পর্দা দরজা ও জানালায় লাগাতেন। বোনরা ঈদের জামার শেষ সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। ভাইয়েরাও মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদে নতুন অন্যরকমের নাশতা বানাতে সাহায্য করতেন।
আব্বা প্রচুর বই ও পত্রিকার সব আর্টিকেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। এমনকি বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা না শুনে একদিনও যেতো না। রোজ সকালে আধা ঘণ্টা ডায়েরি লেখার অভ্যাস, শুনেছি কিশোর বয়স থেকে লিখতেন। সেই ডায়েরি লিখে আবার তা সিন্দুকে ঢুকিয়ে রাখতেন। যা আমার আজও পড়া হয়নি, পড়াও সহজ না। আব্বা ডায়েরি লিখতেন খুব টানা হাতের কারসিব ইংরেজিতে। এই ইংরেজিতে ডায়েরি লেখা নিয়েও জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিলেন, তাঁরা যেহেতু ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছেন, তাই ইংরেজিতে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাবা সব সময় বলতেন, ’পড়ার জন্য পড়বে না, বুঝে ও প্রয়োজনের জন্য পড়।’ মুখস্থ শব্দটা বাবা ঘৃণা করতেন। বাবার মতে, ‘ক্লাসে প্রথম হয়ে তুমি যদি কিছু না বুঝে থাকো, সে প্রথম হওয়া বৃথা।’ অথচ বাবাই ছিলেন সেই আমলে, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বিভাগে প্রথম। এত ভালো রেজাল্ট করে বাংলাদেশেই ছিলেন। ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক ভালো চাকরি পেয়েও যাননি। বাবা আমার বাংলায় কথা বলার জন্য ও সন্তানের বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের জন্য পূর্ব পাকিস্তানেই থাকেন।
শেষ হবে না! অনেক অনেক মজার কথা, আগামী বাবা দিবসের জন্য রেখে দিলাম। আজ শুধু আমি কেন, অন্য সবাইও বলবে, তাদের বাবার কথা। নিজের জীবনের সত্য কিছু কথা...।