আমেরিকায় চিকিৎসা পেশায় দরকার সঠিক পরিকল্পনা

এ এন এম নাজমুল খান। পেশায় একজন চিকিৎসক ও গবেষক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা ও গবেষণা করেছেন। ২১ বছর ধরে বসবাস করছেন আমেরিকায়। বর্তমানে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফোলোয় রোজওয়েল পার্ক কমপ্রিহেন্সিভ ক্যানসার ইনস্টিটিউটে ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনসহ নানা বিষয়ে—
প্রথম আলো: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন...
নাজমুল খান: ১৯৬২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে আমার জন্ম। আমরা ৫ ভাই ও ৬ বোন। বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন মুজিব নগর সরকারের কর্মকর্তা। ১৯৯৪ সালে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী রোকসানা রফিক একজন পুষ্টিবিজ্ঞানী। বর্তমানে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে বসবাস করছি বাফেলো শহরে।
প্রথম আলো: আপনার বেড়ে ওঠা ও গোড়ার দিকের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন...
নাজমুল খান: বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। কৃষি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন। চাকরির সুবাদে প্রতি তিন বছর পর পর বাবার কর্মস্থল পরিবর্তন হতো। তাই বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্কুল-কলেজও পরিবর্তন হতো। ১৯৭৮ সালে লালমাটিয়া বয়েজ হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। তারপর ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। ১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পাই। ১৯৮৭ সালে এমবিবিএস পাস করি।
প্রথম আলো: চিকিৎসক হওয়ার পেছনে কি কাজ করেছে? ছোটবেলা থেকেই কি চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
নাজমুল খান: হ্যাঁ, বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হব। সপ্তম শ্রেণি থেকেই লক্ষ্য ছিল চিকিৎসক হওয়ার৷ কারণ আমাদের সময় তখন দেখতাম, গ্রামেগঞ্জে লোকজন বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। এমনকি সাধারণ ডায়রিয়ায় পরিকল্পিত চিকিৎসার অভাবে তখন মানুষ মারা যেত। এগুলো আমাকে ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তাই লক্ষ্য ছিল, ভালো মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে ভালো ডাক্তার হওয়ার।
প্রথম আলো: ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি?
নাজমুল খান: ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জার্নালের সম্পাদনার কাজও করেছি।
প্রথম আলো: এমবিবিএস পাস করে বের হয়ে প্রফেশনাল জীবন কীভাবে শুরু করেছিলেন?
নাজমুল খান: ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়ার পর ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) তত্ত্বাবধানে দুই বছর বাংলাদেশি নারীদের ওপর নর প্ল্যান্টের প্রভাব মূল্যায়নের ওপর গবেষণার কাজ করেছি। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে নর প্ল্যান্টের কি, সেটি একটু বলি। নর প্ল্যান্টের হলো এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি যাতে হরমোনাল পদ্ধতি ব্যবহার করে নারীদের গর্ভনিরোধ সম্ভব। তারপর সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে সহকারী সার্জনের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯০ সালে বিসিএস পাস করে কয়েক বছর প্রত্যন্ত এলাকায় দায়িত্ব পালন করি। তারপর জুনিয়র কনসালট্যান্ট অব অ্যানেস্থেসিওলোজিস্ট হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ভাসকুলার ডিজিজ রিসার্চে (আইসিভিডিআর) যোগ দিই। সেখান থেকে মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে চলে যাই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বতসোয়ানায়। সে দেশে তখন এইচআইভি, এইডস মহামারি ছিল। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যাবে জেনেও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হতো। ১৯৯৫-৯৮ সাল পর্যন্ত বতসোয়ানায় কাজ করি। তারপর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য ১৯৯৮ সালে পাড়ি জমাই আমেরিকায়।
প্রথম আলো: আপনার ইচ্ছা ছিল ভালো ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু হঠাৎ করেই গবেষণায় কেন আসলেন?
নাজমুল খান: বতসোয়ানায় যখন ছিলাম তখন দেখেছি মানুষ রোগের কাছে কত অসহায়। বাঁচবে না জেনেও বাঁচার কী আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনে! এইচআইভি/এইডসের মত অনেক দুরারোগ্য রোগ আছে, যা থেকে আরোগ্য লাভ সম্ভব নয়। তখন থেকেই আমার মাথায় গবেষণার চিন্তা এসেছিল। চিকিৎসাসেবা দিয়ে সারা জীবনে হয়তো অল্প কিছু মানুষের সেবা করার সুযোগ মিলবে। কিন্তু গবেষণা করে কোন কিছু বের করতে পারলে, তা হয়তো সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের উপকারে আসতে পারে।
প্রথম আলো: আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পরের গল্পটা...
নাজমুল খান: নিউইয়র্ক মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে সহকারী গবেষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে আমার আমেরিকার জীবন শুরু। তারপর ১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফেলোয় (ইউবি) ক্যানসার ইমিউনলজির ওপর পিএইচডি করার সুযোগ হয়। ২০০৫ সালে পিএইচডি শেষ করি। ২০০৮ সালে ক্যানসার ইমিউনলজির ওপর পোস্ট ডক্টরেট করি। ২০১১ সালে রোজওয়েল পার্ক কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার সেন্টারে বিজ্ঞানী হিসেবে মেডিসিন বিভাগে যোগ দিই।
প্রথম আলো: ক্যানসারের ওপর গবেষণা করার আগ্রহ কীভাবে এল?
নাজমুল খান: প্রথমেই বলেছি, আমার চিন্তা ছিল এমন কিছু করা যাতে অনেকের সাহায্যে আসে। বিশ্বজুড়ে অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। তাই নিজের আগ্রহ ও সুযোগ পেয়ে এ পথ বেছে নেওয়া।
প্রথম আলো: বর্তমানে আপনি কি উল্লেখযোগ্য কিছু নিয়ে কাজ করছেন?
নাজমুল খান: মেলানোমা ও প্লাজমা সাইটোসোমা প্রতিহত করার জন্য ক্যানসারের টিকা ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি। চীন ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে এটি ফেজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। তা ছাড়া ওভারিয়ান ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছি। ওভারিয়ান ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৯০ শতাংশই মারা যায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রোস্টেট ক্যানসার শনাক্ত করা গেলেও ওভারিয়ান ক্যানসার শনাক্ত করা এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
প্রথম আলো: নতুন দেশ হিসেবে আমেরিকায় আসার পর কী ধরনের বাধা-বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছিলেন?
নাজমুল খান: আমেরিকায় আসার পর প্রথমেই আমাকে ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। নানা ভাষার লোকজন বাস করে এখানে। তাই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে পড়াশোনা করলেও ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইংলিশের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, নতুন এ দেশে সাহায্য-সহযোগিতা, দিকনির্দেশনা ও বিপদে কাউকে পাইনি। তাই অনেক সময় না জানার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কি কোন পার্থক্য দেখছেন?
নাজমুল খান: অবশ্যই। এ জন্য অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন, যেখানে সারা বছর পড়াশোনা করে পরীক্ষার খাতায় তা উগরে দেওয়া হয়। এ রকম শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করা হয় না। কিন্তু আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কিছু না কিছু অবশ্যই শিখতে হয়। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হয়৷ তা না হলে পার পাওয়া সম্ভব না। পিএইচডি করতে এসে আমাকে লাইব্রেরিতে বসে বসে এখানকার দশম গ্রেডের বায়োকেমিস্ট্রি বইও পড়তে হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনি কীভাবে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছিলেন?
নাজমুল খান: প্রথম থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল, এখানকার বাঙালি কমিউনিটির পাশাপাশি স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করা। বাঙালি কমিউনিটিতে আজও নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। স্থানীয়দের সঙ্গে মেলামেশা না থাকলে আপনি আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না। পড়াশোনা, চাকরিক্ষেত্রে এসব জানা আমি খুবই জরুরি বলে মনে করি। কী পড়াশোনা করলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে, ভবিষ্যতে কোন বিষয়ের চাহিদা বাড়বে, এগুলো নিয়ে চিন্তা করেছি। লক্ষ্য ঠিক করে সে অনুযায়ী কাজ করেছি। আমেরিকা হলো সব পাওয়ার দেশ। ল্যান্ড অব অপরচিউনিটি। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে পরিশ্রম করে গেলে যেকোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব এখানে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ থেকে অনেকে এমবিবিএস পাস করে এসেও সুবিধা করতে না পেরে এখানে ট্যাক্সি, উবার চালাচ্ছে, রেস্টুরেন্টে কাজ করছে। তাদের জন্য এবং বাংলাদেশ থেকে ভবিষ্যতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
নাজমুল খান: বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করে এসে এখানে ফিজিশিয়ানের কাজ করতে হলে অবশ্যই ইউনাইটেড স্ট্যাটাস মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষা (ইউএসএমএলই) পাস করতে হবে। এ পরীক্ষা তিনটি ধাপে নেওয়া হয়। তিনটি ধাপে পাস করার পর বিষয় অনুযায়ী ৩-৭ বছর রেসিডেন্সি করতে হয়। তারপরেই এখানে ফিজিশিয়ান হওয়ার সুযোগ মিলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এ প্রক্রিয়া কিছুটা সময়-সাপেক্ষ। তারপর ইউএসএমএলই পাস করার পর রেসিডেন্সির জন্য অনেক প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কারণ একই পজিশনের জন্য অনেক ভারতীয়, চায়নিজ, পাকিস্তানিসহ অন্যান্য দেশের অভিবাসী লড়াই করে থাকে। রেসিডেন্সি পাস করার পর ভালো হাসপাতাল, ক্লিনিকে অনুশীলন করার সুযোগ নাও মিলতে পারে। তখন সময় ও পরিশ্রম অনুযায়ী এত কিছু করা বৃথা মনে হতে পারে। কাউকে নিরুৎসাহিত করতে বলছি না, আত্মবিশ্বাস না থাকলে এ প্রক্রিয়ায় মাঝপথে হারিয়ে গেলে অনেকটা জগাখিচুড়ি অবস্থা হবে। তাই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো উচিত।
প্রথম আলো: ইউএসএমএলই না দিয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে বিকল্প কোন পন্থা আছে কি?
নাজমুল খান: অবশ্যই আছে। মাস্টার্স অথবা পিএইচডি করা যেতে পারে। এ জন্য জিআরই ও টোফেলের মতো পরীক্ষা লাগতে পারে। ভবিষ্যতে ইমিউনোলজি, জেনেটিকস, বায়োইনফরমেটিক্স, বায়ো স্ট্যাটিসটিকস—এসব বিষয়ের চাহিদা বাড়বে। তাই এসব বিষয়ের ওপর উচ্চতর শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া অ্যালাইড হেলথ যেমন আল্ট্রাসনোগ্রাম, রেডিওলজি ইত্যাদির ওপর কোন সার্টিফিকেশন কোর্স করা যেতে পারে। এগুলো খুবই ফলপ্রসূ। কারণ স্বল্প সময়ে পড়া শেষ করে ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। মনে রাখবেন, কোন সার্টিফিকেট থাকলে অবশ্যই ভালো চাকরি পাওয়ার আশা থাকবে।
প্রথম আলো: আমেরিকায় পড়াশোনা করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কোন পরামর্শ...
নাজমুল খান: ছাত্রাবস্থায়ই ভলান্টিয়ারিং ও বিভিন্ন ইন্টার্নশিপ করা। এতে অভিজ্ঞতা বাড়বে। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে পরিচয় হবে। ছাত্রাবস্থায়ই কোন বিষয় পড়তে ভালো লাগছে বা কোন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, তা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। তাই সেমিস্টার ব্রেক, গ্রীষ্মে বসে না থাকে ইন্টার্নশিপ ও ভলান্টিয়ারিং করা উচিত।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ
নাজমুল খান: আপনাকেও ধন্যবাদ