আমেরিকায় জন্মেও নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে না?

আমেরিকায় জন্ম নিলেও নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে না। অভিবাসন নিয়ে একের পর এক তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে ফেলেছেন, সংবিধানে নিশ্চিত করা এ অধিকারটিও তিনি কেড়ে নিতে চান। আইনের ফাঁক বের করে নির্বাহী আদেশ দিয়ে কার্যকর করতে চান নতুন নিয়ম। যে নিয়মে মা-বাবা আমেরিকার নাগরিক না হলে, মা-বাবা এখানকার বৈধ অভিবাসী না হলে আমেরিকার মাটিতে জন্ম নেওয়া শিশুরা নাগরিক হতে পারবে না।
‘বার্থ রাইট’ নামে নাগরিকত্বের জন্য চালু থাকা আইন বদলে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে নিজের রক্ষণশীল ভিতকে আরও উসকে দিতে তাঁর এ বক্তব্য উদারনৈতিকদের সমালোচনায় পড়েছে। উদ্বেগে পড়েছেন অভিবাসীরা। প্রথমে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, এর পর অভিবাসনের নানা কালাকানুন আরোপ করার মধ্য দিয়ে অনুসৃত কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু ৩০ অক্টোবর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ট্রাম্পের যে বক্তব্য প্রচার হলো, তা এক কথায় স্তব্ধ করে দিয়েছে সবাইকে। অভিবাসনের বিরুদ্ধে কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে আগ্রাসী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে ট্রাম্পের সর্বশেষ এ ঘোষণাকে। সময় বিবেচনাতেও বিষয়টি সবাইকে বিস্মিত করেছে। কারণ মধ্যবর্তী নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি।

হাউস স্পিকার পল রায়ান এ নিয়ে নিজ দলের প্রেসিডেন্টের মতের সঙ্গে ভিন্নতা প্রকাশের একদিন পর তিনিও ট্রাম্পের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ৩১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, স্পিকার রায়ান জন্মগত নাগরিকত্বের কী জানেন?’ রিপাবলিকান দলের এই নেতাকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে দল ভালো করার উপায় নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। প্রভাবশালী রিপাবলিকানরাও বলছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট এমন বক্তব্য দলের জন্য ক্ষতিকর। নিজ দলের স্পিকারকে আক্রমণ করাটাও রিপাবলিকান দলের অনেকেরই উষ্মার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি একটি নতুন এইচবিও সিরিজের জন্য ট্রাম্প একটি সাক্ষাৎকার দেন। অ্যাক্সিওসে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারের পুরোটা এখনো প্রচার হয়নি। তবে এর কিছু অংশ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয়। ওই সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প তাঁর স্বভাবসুলভ আগ্রাসী বক্তব্যে বলেন, ‘বিশ্বে আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে একজন মানুষ আসেন, আর একটি সন্তানের জন্ম দেন, যে সন্তান অবশ্যই হয় একজন মার্কিন নাগরিক। ওই সন্তান আমেরিকার সব সুযোগ-সুবিধা চেয়ে বসে। এটা হাস্যকর। হাস্যকর। এর শেষ হওয়া উচিত।’ তিনি বলেছেন, এ ‘হাস্যকর’ বিষয়টি তিনি বন্ধ করতে চান। হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ও আইনজ্ঞদের নিয়ে তিনি পরামর্শ করছেন। নির্বাহী আদেশ দিয়ে তা করা যায় কিনা পরখ করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, প্রক্রিয়া চলছে, হয়ে যাবে। দ্রুতই এ নিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন তিনি।
গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৮ সালে আমেরিকার সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী গৃহীত হয়। সেখানে বলা আছে, ‘আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী সবাই জন্মগতভাবে আমেরিকার নাগরিক।’ মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮২ সালে দেওয়া এক রায়ে সংবিধানের এ ধারাকে সমুন্নত রেখে রায় দিয়েছেন। যদিও আমেরিকায় অবৈধভাবে বসবাসকারী বা ভ্রমণে এসে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে সংবিধান বা সুপ্রিম কোর্টের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এ সুযোগটিই নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে স্বীকৃত, যার মধ্যে রয়েছে কানাডা ও মেক্সিকোও। এ ধরনের পদক্ষেপের আইনি বৈধতা রয়েছে কিনা এই নিয়েই এখন আলোচনা শুরু হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে ট্রাম্প ইচ্ছা করেই একটি বিতর্ক শুরু করেছেন। কারণ আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই হয়তো ট্রাম্পের বক্তব্য ও হোয়াইট হাউসের কিছু পদক্ষেপ এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যা ট্রাম্প সমর্থকদের নির্বাচন সামনে রেখে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মেক্সিকো সীমান্ত অভিমুখে আসতে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশী ক্যারাভান নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। ওই ক্যারাভানকে তিনি তাঁর বহুল কথিত ‘আমেরিকান অভিবাসন নীতিতে বিদ্যমান দুর্বলতা’র চিহ্নবাহী হিসেবে বর্ণনা করছেন।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প জন্মসূত্রে নাগরিকত্বকে ‘নোঙর শিশু’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়টি বন্ধ করা সম্ভব। যদিও এই অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধিকাংশ আইন বিশেষজ্ঞ। অ্যাক্সিওসকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাকে সব সময় বলা হয়েছে যে, এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে নানা সংকট রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসে আইন পাসের মাধ্যমে বিষয়টি অবশ্যই করা সম্ভব। কিন্তু এখন তারা বলছে যে, আমি এটা একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই করতে পারি। এটা এখন প্রক্রিয়াধীন। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই এটা ঘটবে।’
প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেতা স্পিকার পল রায়ান অবশ্য জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অবসানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নন। তাঁর মতে, ‘নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার অবসান করতে পারবেন না (প্রেসিডেন্ট)। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নির্বাহী কর্মসূচির মাধ্যমে অভিবাসন আইন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। সংবিধানে বিশ্বাসী রক্ষণশীল হিসেবে আমরা এটি পছন্দ করিনি। তবে অভিবাসন সমস্যার সমাধানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে একমত আমি।’ এই বক্তব্যের পরই পল রায়ানকে আক্রমণ করে বসেন ট্রাম্প।
প্রসঙ্গত, আমেরিকার সংবিধান সংশোধন খুবই জটিল প্রক্রিয়া। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও তিন চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। রাজ্যের তিন-চতুর্থাংশ আইনপ্রণেতা সংবিধান সংশোধনের সম্মেলন আহ্বান করতে পারেন। সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হলে আমেরিকার তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদন নিয়েও সংবিধান সংশোধন করা যায়।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বন্ধে নির্বাহী আদেশ দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও এটা ঠিক কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে ট্রাম্প কিছুই বলেননি। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর টিম কেইন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্সি কোনো একনায়কতন্ত্র নয়। সংবিধান নতুন করে লেখার যে একতরফা পদক্ষেপের কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশপ্রেমী নাগরিকের রুখে দাঁড়ানো উচিত।’
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাবাদর্শের অন্যতম সহযোগী রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের মতো একটি আইন প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। যদিও তিনি পরিষ্কার করেননি প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন কিনা। ২০১০ সালে সিনেটর গ্রাহাম জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার অবসানের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবের কথা বিবেচনা করেছিলেন বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের মতো বিষয় অবসানের জন্য আমাদের সংবিধান পরিবর্তন করা উচিত।’
মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ইমিগ্রেশনের জুজু বুড়ির ভয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকদের চাঙা করছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসীর কাফেলা ধেয়ে আসছে দক্ষিণের সীমান্তের দিকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলে আসছেন , এ অবৈধ ইমিগ্রান্ট কাফেলায় জঙ্গিরা আছে, আছে খুনি গ্যাংয়ের সদস্যরা।’ প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছেন। ভয় দেখাচ্ছেন আমেরিকার লোকজনকে।
মুসলমান হলে জঙ্গি, আর দক্ষিণ আমেরিকান হলে গ্যাং সদস্য—এ ভয় তাড়িত করছে আমেরিকার তৃণমূল পর্যায়ের শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীলদের। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বক্তব্য দিয়ে এই জনসমর্থনের পালেই হাওয়া লাগাতে চাইছেন।
তবে পলিটিকোয় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেন, ‘ট্রাম্পের এ বক্তব্য মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে কোনো রাজনৈতিক চাল নয়। আমাদের দক্ষিণ সীমান্তে যে সংকট চলছে, তা স্বীকার করা উচিত।’
আমেরিকার জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে এ বিতর্ক অবশ্য অনেক পুরোনো। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক আমেরিকায় নানাভাবে এসে সন্তান জন্ম দেন আমেরিকায়। ‘বার্থ টুরিজম’ নামে পরিচিত এ প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আমেরিকায় আসেন। চীন, রাশিয়া থেকে শুরু করে আমাদের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় শুধু সন্তান জন্ম দিতে আসা লোকজনের সংখ্যা অনেক। এসব গর্ভবতী মায়েদের ও সদ্যোজাত সন্তানদের চিকিৎসা ব্যয় আমেরিকার নাগরিকদের ওপর পড়ে।
বিষয়টি নিয়ে ন্যাশনাল রিভিউতে লেখা এক নিবন্ধে নিউইয়র্কের আইনজীবী ড্যান ম্যাকললিন লিখেছেন, ‘বিচক্ষণতা বিবেচনায় (জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের) বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের জায়গা থাকলেও আইনটি নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিত নয়। বিদ্যমান মার্কিন সংবিধানমতে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া প্রতিটি ব্যক্তির আমেরিকান নাগরিকত্ব প্রাপ্য।’
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার অভিবাসন বিরোধিতার চরম এ সময়ে বিষয়টিকে আরও উসকে দিতে চাইছেন। হয়তো নির্বাহী আদেশ জারিও করবেন তিনি। তবে অভিবাসী গ্রুপ ও উদারনৈতিক মহল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ পদক্ষেপকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।