আমেরিকায় যেভাবে দুর্গোৎসব উদ্যাপন করে নতুন প্রজন্ম

আকাশ সেনগুপ্ত, পার্বতী দাশ, অদ্রি চৌধুরী, পঞ্চতপা
আকাশ সেনগুপ্ত, পার্বতী দাশ, অদ্রি চৌধুরী, পঞ্চতপা

বাংলার আকাশে এখন ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের ছোটাছুটি, কাশবনে কাশফুলের দোল, শিউলি ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা চারিদিক। অবশ্য সুদূর মার্কিন মুলুকে এসবের কোনো ছোঁয়াই নেই। তবু অন্তরে লালিত দেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি মনকে জানান দেয়-ঋতুটা শরৎ, সময়টা শারদোৎসবের। আর এই বার্তা পেয়েই প্রবাসী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে উঠেছে শারদোৎসবের হরেক আয়োজনে।
সারা বিশ্বের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতো নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের আটলান্টিক সিটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি সনাতনী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনায় ব্যস্ত। সুদূর এই প্রবাসে বহুজাতিক ধর্মীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মনোজগতে এই দুর্গোৎসবের কতটুকু আবেদন রয়েছে, সেই বিষয়টি জানতে কথা হয় এই প্রজন্মের কয়েকজনের সঙ্গে। দুর্গাপূজার সময় স্কুল বন্ধ না থাকায়, সবারই কিছুটা আফসোস থাকে, পূজার আনন্দটুকু তারা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারে না।
এদের একজন তিলাঞ্জলী কর্মকার। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া তিলাঞ্জলি আমেরিকায় এসেছেন পাঁচ বছর বয়সে। আটলান্টিক সিটি হাই স্কুলের দশম গ্রেডের এই ছাত্রী জানাল, পূজার দিনগুলো সে স্থানীয় গীতা সংঘের দুর্গোৎসবেই কাটায়। সন্ধ্যা গড়াতেই মা-বাবার সঙ্গে নতুন পোশাকপরিচ্ছদে সেজে উৎসব প্রাঙ্গণে ছুটে যায়, দেবীর প্রার্থনা করে। তাদের জন্য নির্ধারিত দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে। অন্যদিন অন্যান্যের পরিবেশনা উপভোগ করে। আর প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে ঢোল-করতালের তালে তালে সমবয়সীদের সঙ্গে আরতি নৃত্যে মেতে ওঠা-তার কাছে এক অনাবিল আনন্দ। তবে বিজয়া দশমীর দিন সকালে তার মন বিষাদে ভরে যায়। সংগীত রজনীর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে সেই বিষাদ কিছুটা লাঘব হয়।
তিলাঞ্জলী জানায়, বাংলাদেশের পূজার অনেক কিছুই সে এখানে উপভোগ করতে পারে না। বিশেষ করে পূজার অনেক আগে থেকেই মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিপণিবিতানে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা, মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখা, দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জন—এসব কিছু তাকে বেশ পীড়া দেয়। তারপরও সে মনে করে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এখানে পূজার যে কয়টা দিন আনন্দ-উৎসবে কাটে তাও কম কীসে?
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা পার্বতী দাশ এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠলেও শিল্পবোদ্ধা মা-বাবার সার্বিক দেখভালে এই দেশের বহুজাতিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তার মনোজগতে তেমন আঁচড় কাটতে পারেনি। পার্বতী দাশ সভরেন অ্যাভিনিউ স্কুলের অষ্টম গ্রেডের ছাত্রী। এই শিক্ষার্থী জানাল, স্থানীয় গীতা সংঘ আয়োজিত দুর্গোৎসবের কয়টা দিন সে বেশ আনন্দ-উৎসবেই কাটায়। তাদের জন্য নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে নৃত্য পরিবেশন করে, অন্যান্য দিন বাকিদের পরিবেশনা উপভোগ করে। পূজার অনেক আগে থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া শুরু হয় বলে সে ক্ষণগণনা করতে থাকে-’মা আসছে....।’ পুজোর সময় স্কুল খোলা থাকায় লাগামহীনভাবে আনন্দ করতে পারে না বলে তার মন একটু খারাপই থাকে। দশমীর দিন সিঁদুর খেলার ক্ষণটা সে বেশ উপভোগ করে। এ ছাড়া সংগীত সন্ধ্যায় বান্ধবীদের সঙ্গে সে নেচে-গেয়ে বেশ আনন্দ পায়। দেশে পূজার কোনো সুখস্মৃতি তার না থাকলেও নাড়ির বন্ধন অটুট রাখতে প্রবাসে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দুর্গোৎসবের আনন্দটুকু কোনোভাবেই হারাতে সে রাজি নয়।
চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আকাশ সেনগুপ্ত ছয় বছর বয়সেই বাবা-মার সঙ্গে আমেরিকায় আসে। এরপর ভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠলেও অভিভাবকদের সার্বিক দেখভালে আকাশ ধর্মীয় অনুশাসন বেশ ভালোই মেনে চলে। বর্তমানে চেলসি হাইটস স্কুলের অষ্টম গ্রেডের ছাত্র আকাশ জানায়, বিভিন্ন ধর্মীয় আচারাদি পালনের মাধ্যমে সে চার দিনব্যাপী দুর্গোৎসব উদ্‌যাপন করে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে সে নতুন জামা-কাপড় কেনে, মার হাতে তৈরি বিভিন্ন খাবার খায়। পূজার সময় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। দুর্গাপূজা শেষে অনুষ্ঠিত সংগীত রজনীতে বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনা সে প্রাণভরে উপভোগ করে। পূজার সময় বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের তার খুব মনে পড়ে।
চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া অদ্রি চৌধুরী বাবা-মার সঙ্গে সাত বছর বয়সেই আমেরিকায় আসে। এখানকার বহুজাতিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠলেও আপন কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে রেখেছে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে। সে নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করে। চেলসি হাইটস স্কুলের অষ্টম গ্রেডের এই ছাত্র জানাল, পূজার কয়টা দিন সে মাতৃদেবীর আরাধনা করে, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করে, নৃত্যারতি করে। সে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে, বিভিন্ন পদের মুখরোচক খাবার খায়। তার মনে খুব খেদ, দুর্গাপূজার সময় স্কুল বন্ধ না থাকায় মনমতো পূজার আনন্দটুকু উপভোগ করতে পারে না। দুর্গাপূজা শেষে সংগীত রজনীতে শিল্পীদের পরিবেশনার সময় সমবয়সীদের সঙ্গে মিলেমিশে নাচ-গান সে খুবই উপভোগ করে। বাংলাদেশে পূজার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে গিয়ে প্রতিমা দর্শন সে খুব মিস করে। তা ছাড়া পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা বিসর্জনের যে আবহ এটা সে খুব মিস করে।
নর্থফিল্ডে বসবাসরত পঞ্চতপা বলের জন্ম চট্টগ্রামে। তাঁর বয়স যখন আড়াই বছর তখন মা-বাবার সঙ্গে সে আমেরিকায় আসে। তার মা-বাবা দুজনই শিল্পমনা হওয়ায় একটা বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তার বেড়ে ওঠা। নর্থফিল্ডের মেইনল্যান্ড রিজিওনাল হাইস্কুলের নবম গ্রেডের এই ছাত্রী জানাল, পূজার চার দিন সে খুব আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটায়। পূজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে তার সমবয়সীদের পরিবেশনা প্রাণভরে উপভোগ করে। নিজেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। দুর্গাপূজায় ঢাকের বাদ্যির তালে তালে হাল ফ্যাশনের পোশাক পরে বান্ধবীদের সঙ্গে নাচার মুহূর্তটা তার কাছে খুবই প্রিয়। বিজয়া দশমীর দিন লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে অঞ্জলি শেষে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠা সে খুব উপভোগ করে। সংগীত রজনীতে শিল্পীদের পরিবেশনার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে মিলেমিশে নেচে-গেয়ে বেশ উপভোগ করে। পূজার কেনাকাটা সে প্রায়ই অনলাইনেই সেরে ফেলে।
আমাদের এই প্রবাস প্রজন্ম দিবানিশি ভিন্ন সংস্কৃতির ডামাডোলের মধ্যেও যে এখনো নিজস্ব ধর্মীয় অনুশাসন মেনে আচারাদি পালন করছে, বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অন্তরে লালন করছে, ভিনদেশি সংস্কৃতির চোরাবালিতে পা ফেলছে না-তা সত্যিই আশা জাগানিয়া।