আরেক শরৎশশী
মানুষ হানিমুন করতে পাহাড় কিংবা সমুদ্র দর্শনে যায়, আমরা গিয়েছিলাম কলকাতায়। এই হানিমুন দিয়ে আমার আক্ষরিক অর্থে বিদেশ সফর শুরু। কলকাতাকে অবশ্য সেই অর্থে বিদেশ বলা চলে না। আজন্ম কুয়োর ব্যাঙ আমি সেই কলকাতা দেখে যারপরনাই অভিভূত। এত বছর প্রিয় লেখকদের উপন্যাসে যে যব জায়গা আর রাস্তার নাম দেখেছি, সেই সব জায়গায় আমি হাঁটছি, ঘুরছি, কেনাকাটা করছি, মনে হচ্ছিল কোন উপন্যাসের পৃষ্ঠার মধ্যে বাস করছি । ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস, শিয়ালদহ, গড়িয়া, গড়ের মাঠ সব যেন কত দিনের চেনা!
আমার স্বামী সাঈদের বন্ধুরা হানিমুনে আমাদের কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে অনেক মজা নিয়েছিল। আজকাল ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া যাওয়া রীতিমতো ডালভাত। ভিসাও করতে হয় না। এয়ারপোর্টে ট্রানজিট ভিসা পাওয়া যায়। সেখানে আমরা কেন কলকাতা যাচ্ছি, সেটাই ছিল তাদের তির্যক জিজ্ঞাসা। আমার নতুন বিয়ে করা স্বামী মুখ ফুটে বলতে পারিনি যে, আমার কারণেই তার এই সিদ্ধান্ত। মনে মনে সে যে কিছুটা বিরক্ত সেটা বুঝতে পেরেছি। তবে কলকাতায় এসে আমার আনন্দে দিশেহারা আচরণ তাকে কিছুটা প্রভাবিত করেছে। হয়তো ভাবছে, এত অল্পতেই যে খুশি থাকে, তাকে আর এত টাকা খরচ করে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া নেওয়ার কি দরকার! এমনিতে কদিন আগে বিয়ে উপলক্ষে তো কম টাকা যায়নি।
আসার আগে বন্ধু কাজল বলে দিয়েছিল, নন্দনে নাটক না দেখে আসবি না। কলকাতা যাওয়ার দুই দিনের মধ্যে নাটক দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নির্ধারিত দিনে নাটক শুরুর ঘণ্টা দু-এক আগেই আমরা নন্দনে চলে গেলাম। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে কিছু খাওয়া হয়নি। আমি নুডলস অর্ডার দিই। ওরা বলে চাওমিন। অসাধারণ স্বাদ। আমার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে অনেকে ফিরে তাকায়। আমার স্বামী কিছুটা বিরক্ত স্ত্রীর আদিখ্যেতা দেখে। তবে নতুন তো, তাই কিছু বলছে না। নাটকও তার দেখার ইচ্ছা ছিল না। আমার তো শুনে আক্কেলগুড়ুম! সে নাকি জীবনে কখনো মঞ্চনাটক দেখেনি। এই প্রথম আমার কারণে দেখতে বাধ্য হচ্ছে।
নাটকের নাম দর্পণে শরৎশশী। সাঈদ খুব অনাগ্রহের সঙ্গে নাটকটা দেখা শুরু করল। সম্ভবত আজ সকালে ‘বিবাহিত জীবনে সুখী হইবার উপায়’ টাইপের কোন লেখা পড়েছে ও। তাই আমার কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখছে না। বেশিক্ষণ স্বামীকে নিয়ে মাথা ঘামাতে পারলাম না। নাটকে ডুব দিলাম। নাটকের কাহিনিতে দেখা গেল, একটা যাত্রা দল গ্রামে এসেছে শো করতে। স্থানীয় জমিদার তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওই দলের এক মেয়ের নাম শরৎশশী। তখনকার সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী যাত্রা দলের নারী সদস্যরা আবার দেহোপজীবিনিও। গৃহস্থ ঘরের মেয়ে শরৎশশী যাত্রা দলে আসার পেছনে নীলকরদের অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এক জেলা মেহেরপুরের আমঝুপির নীলকুঠির কথা বলে মেয়েটি। নাটকের নায়িকার মুখে আমঝুমি গ্রামের নাম শুনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয় আমার স্বামীর। সে তো পারলে রীতিমতো সিট থেকে দাঁড়িয়ে যায়। নাটক দেখতে প্রচণ্ড অনিচ্ছুক আমার স্বামীকে দেখি আমার চেয়েও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নাটকটা দেখছে।
এতটাই মুগ্ধ যে, নন্দন থেকে বের হওয়ার পরেও আমার স্বামী কিছু বলে না। বুঝি, সে এখন নাটকের ঘোরের মধ্যে আছে। রুমে ঢুকে কাপড় না পাল্টেই আমি তাকে ধরি, কি ব্যাপার নাটক দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে গেছ! মুখে কোন ভাষা নেই!
বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আমি বেশ স্বাভাবিক কথাবার্তায়, কিন্তু আমার স্বামী কিছুটা আড়ষ্ট এখনো। তার আড়ষ্টতা আরও বেড়ে গেল নাটকটি দেখার পরে। নাটক প্রসঙ্গে কোন কথা বলল না। পরের দিনের ঘোরার পরিকল্পনা করে ঘুমিয়ে পড়ল বেশি কিছু না বলে! হানিমুনে এসে স্বামীর এভাবে ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টা আমার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক হলেও কিছু বললাম না! বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম, তার কি হতে পারে? মেহেরপুরের আমঝুপিতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে কুষ্টিয়া চলে আসে। তারপর ঢাকায়। বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকায় শিকড়ের সঙ্গে এখনো সাঈদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
পরদিন সকালে নিউমার্কেট এলাকায় খালেক নামে একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য বের হই আমরা। বেলা তখন দশটা বেজে গেছে। চারদিকে গাড়ির হর্নের শব্দ। টানা রিকশাওয়ালারা ব্যস্ত। কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। ঢাকার মতো ফুটপাতে ফেরিওয়ালাদের ভিড়। তবে কলকাতা বলে অত খারাপ লাগছিল না। আমি দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। কিছু বুটিক হাউসও আছে আশপাশে। একটার দরজায় দাঁড়িয়ে কাশ্মীরি শাল দেখছিলাম। এর মধ্যে আমার স্বামীকে হারিয়ে ফেললাম। তবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। খালেক রেস্টুরেন্টে গেলে তাকে পাব। সেখানে না পেলে ফোন তো আছেই।
‘তোমার কি সমস্যা বলত, যেখানে যা চোখে পড়ে, সেটাই দেখতে থাকো?’ হঠাৎ কানের কাছে শুনি একজন পুরুষের গুরুগম্ভীর আওয়াজ। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, ততোধিক গম্ভীর তার চেহারা। রাগে থমথমে। আমার ঠিক পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী একজন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে পুরুষটি। চেহারা আর কথার টানে বোঝা যাচ্ছে, আমার মতো বাংলাদেশ থেকে এসেছে তারা। ভদ্রমহিলা আমার দিকে অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে সামান্য তাকালেন। তারপর আড়চোখে স্বামীকে দেখে নিয়ে উনি আরেক দিকে চলে গেলেন। ভাবটা এমন করলেন, স্বামীর কথা তার কানে যায়নি।
হঠাৎ মনে হলো সাঈদের কথা। বিয়ের পরের এই কদিনে সাঈদকে রাগত কণ্ঠে কোনো কথা বলতে দেখিনি। তবে সে স্বল্পভাষী। অন্তত আমার চেয়ে নিঃসন্দেহে! মনে হলো, এভাবে একা একা ঘোরাটা উচিত হচ্ছে না। সাঈদকে ফোন করা দরকার। ঘুরে দাঁড়াতে এক লোকের সঙ্গে জোরে ধাক্কা খেলাম। দোষটা লোকটারই। সে এতটুকু দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়নি। আমি সামনে না গিয়ে পেছনে ঘুরলেই তার সঙ্গে ধাক্কা খেতে হতো।
‘আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি দিদি?’ লোকটা যথাসম্ভব বিনয়ী কণ্ঠে কথাটা জানতে চাইল। কিন্তু তাতে নিজের চোখের ধূর্তামি ঢাকতে পারল না। বোঝা যাচ্ছে লোকটা ভালো নয়।
‘বলেন কি জানতে চান?’ কথাটা লোকটাকে বললেও আমার দুই চোখ খুঁজছিল সাঈদকে। কোথায় গেল মানুষটা? আজব তো! ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করি সাঈদকে ফোন করার জন্য।
‘আপনি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমাদের হোটেলে উঠতে পারেন। খুব ভালো হোটেল। এখানকার সবচেয়ে কম রেট।’ লোকটা থামতেই পাশে আরেকজন এসে উপস্থিত হলো। সে থামিয়ে দিল প্রথম লোকটাকে। ‘ওদের হোটেলের রেট কম বিশ্বাস করবেন না দিদি। ওদের এসি তো কাজই করে না। আর বাথরুম খুব ছোট। আমরা ডাবল বেডের রুম সিঙ্গেল বেডের খরচে দেব। আপনি তো একা দিদি, তাই না?’
বুঝতে পারলাম, দুজনেই এখানকার হোটেলের দালাল। কাস্টমার নিয়ে গেলে হোটেল কর্তৃপক্ষ কিছু টাকা দেয়। আর সেই টাকা মনে হয় মদ-গাঁজা খেয়েই শেষ করে ফেলে।
প্রথম লোকটা হঠাৎ ক্ষেপে গেল। ‘আমি একজন কাস্টমার খুঁজে পেয়েছি, তুই মাঝখানে কথা বলার কে?’ দুজনের চাপানউতরে আমি সাঈদকে ফোন করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। লোক দুটোর ঝগড়া এমন একপর্যায়ে গেল যে পারলে আমার হাত ধরে জোর করে টেনে ওদের হোটেলে নিয়ে যায়। হঠাৎ দেখি, লোক দুটো ধাক্কা খেয়ে একজন আরেকজনের গায়ে গিয়ে পড়ল।
‘একা মেয়ে মানুষ দেখলে তোদের খুব আনন্দ হয়, তাই না? একদম খুন করে ফেলব’—সাঈদের অগ্নিমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। বিয়ের পর এই কদিনে ওকে খুব নিরীহ-শান্ত মানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু এ কোন চেহারা! আমার কল্পনার ধারে কাছেও ছিল না!
লোকগুলো প্রথমে হতচকিত হয়ে গেলেও পরে তেড়ে আসল। তারা জানে, আমরা এখানে বহিরাগত। তাদের ক্ষমতা অনেক বেশি। হয়তো এখানে থানা-পুলিশও ওদের পরিচিত। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই হবে। আমি এবার সত্যি ভয় পেলাম। কোন ধরনের মারামারি হলে থানা পর্যন্ত ঘটনাটা গড়াবে।
আমি শক্ত করে সাঈদের হাত ধরলাম। এখান থেকে ওকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে দেখলাম বেপরোয়া। রাগে অস্থির হয়ে গেছে। লোকগুলো এবার এসে যাতা বলা শুরু করল। ‘তুই এর কি হস? বয়ফ্রেন্ড নাকি? নাকি ভাতার?’ এরপর আরও জঘন্য সব কথা বলা শুরু করল। ওরা সাঈদকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে, বুঝতে বাকি রইল না।
সাঈদ গিয়ে প্রথম হোটেলের দালালের শার্টের কলার ধরে বসল। সেও এক হাতে সাঈদের গেঞ্জি ধরে টান দিল।
‘কি করছেন, কি করছেন? ছাড়েন ছাড়েন...’। জোর খাঁটিয়ে আমার স্বামীকে ছাড়িয়ে আনল এক লোক। তাকিয়ে দেখলাম, একটু আগের সেই স্বামী যে স্ত্রীকে ধমকেছিল। লোকটা এখানে এসেও হোটেলের দালালদের ধরে ধমক দিল। তবে সাঈদের মতো মাথা গরম করল না। ওদের আগেই সে পুলিশের ভয় দেখাল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগলেও সাঈদ তেমন কিছু বলল না। মানে আমি বলতে দিলাম না। হোটেলে ফিরেই সাঈদ যাওয়ার টিকিটের সময়ের পরিবর্তন করল। আমাদের আরও দুই দিন থাকার কথা। কিন্তু সে কাল সকালেই চলে যাবে। আমি আর বাধা দিলাম না।
কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেই সাঈদ সিদ্ধান্ত নেয়, সে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাবে। সাঈদের বাবা-মা আর ওর এক ভাই গ্রামে থাকেন। অন্য সবাই বাড়ি ছেড়েছে অনেক আগে। সাঈদ ওর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার মতামত নেওয়ার দরকার মনে করে না। আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়। কিন্তু কিছু বলি না। আসলে আমাদের দুজনের সেভাবে স্বাভাবিক কথা হচ্ছে না। কলকাতা থেকে আসার পর থেকে আমাদের মধ্যে প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা হয় না। বিয়ে উপলক্ষে নেওয়া সাঈদের ছুটি এখনো শেষ হয়নি। বাকি সময়টা সে গ্রামের বাড়িতে কাটাতে চাইছে।
যাওয়ার দিন সকালে দেখি সাঈদ একটা গাড়ি ভাড়া করেছে। আমরা যে তিন দিন থাকব, গাড়িটা আমাদের সঙ্গে থাকবে। গাড়িটা দেখে মনটা একটু প্রসন্ন হয়। তারপর যেতে যেতে মন পুরো ভালো হয়ে যায়। ঢাকায় জন্ম আর বেড়ে উঠেছি বলে অন্যান্য জেলা সম্পর্কে ধারণা নাই। যমুনা সেতু পার হওয়ার পরে চারদিকের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ মন ভালো করে দেয়। কি বিশাল চলনবিল। নিবিড় সবুজের মাঝে মনের ভার দূর হয়। তারপর টুকটাক প্রশ্নে আমরা কিছুটা কাছে চলে আসি। সাঈদের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসি। সে আমার কপালের এক পাশে হালকা চুমু দিয়ে বলে, ‘পরের বার আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাব। এর মধ্যে আমি গাড়ি কিনব। তারপর আমি ড্রাইভ করব।’
‘না, আমি ড্রাইভ করব।’ আমি স্বভাবসুলভ সব বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাই। সাঈদ তাতে হাসে। ‘কোন সমস্যা নেই। ঢাকায় ফিরে দুজনে এক সঙ্গে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হব।’
আমরা নানা জায়গায় থামতে থামতে যাই। মেহেরপুরের আমঝুপিতে শ্বশুরবাড়ির গ্রামে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নতুন বউ এসেছে বলে বাড়িতে সাজ সাজ রব। আশপাশে সব বাড়ির নানা বয়সী নারীরা আসা শুরু করল আমাকে দেখতে। গ্রাম হলেও বাড়ির ভেতরে সবকিছু শহরের মতো। আবার কত খোলামেলা। কেন যে মানুষ শহরে থাকে! আমার মাথায় আসে না।
তবে গ্রামের লোকজনের অতি কৌতূহলী মনোভাব ভালো লাগে না। সবাই যেন দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে সারাক্ষণ আমাকে দেখছে। ভাশুরের ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেলে রাতুল হাসতে হাসতে বলে, ‘আমাদের চাচিকে দেখতে টিকিট কাটতে হবে কিন্তু। না হলে দেখা যাবে না।’ আমার হাসি পায় রাতুলের কথায়। পুরো বাড়িতে ওকে খুব পছন্দ হয়ে যায় আমার। পরের দিনদুপুরে নানারকম পদ দিয়ে খাওয়ার পরে রাতুলকে জিজ্ঞাসা করি নীলকুঠির কথা। কলকাতার নাটকে নীলকরদের অত্যাচারের কারণে গ্রাম ছাড়া শরৎশশীর গল্প সবাইকে বলি।
‘ও আমাদের ঐতিহাসিক নীলকুঠির কথা বলছেন?’ রাতুলের মুখে ঐতিহাসিক শব্দটা শুনে হাসি পায়। আমার ভাশুর বলেন, ওটা নাকি আগে ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেন তিনি সেখানে। পলাশীর প্রান্তর মেহেরপুর জেলার সীমান্তে। ভাবলাম, হতেও পারে।
আমাদের আলোচনায় সাঈদ দেখি আশ্চর্য চুপচাপ। কলকাতায় গিয়ে নাটকে নিজের গ্রামের নাম শুনে তার উচ্ছ্বাসের কথা কিছু বলে না। এমনকি আমি যখন বিকেলে নীলকুঠিতে যেতে চাইলাম, সে কোনো উৎসাহ দেখাল না। আমি এখানে নতুন বউ। একা যাওয়া কেমন দেখায়!
‘এত তাড়াহুড়া কিসের? আমরা আজকেই চলে যাচ্ছি না।’ সাঈদের আচরণ খুব বিরক্ত করলেও আমি সিদ্ধান্ত থেকে সরি না।
‘তুমি যদি না যেতে চাও তাহলে রাতুলকে সঙ্গে নিয়ে যাব আমি। ও সব চেনে।’ আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিই। সাঈদ কিছু বলে না। গাড়িতে রাতুলকে নিয়ে আমি বের হয়ে পড়ি অসংখ্য দর্শনার্থীর দৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
আমঝুপি বাজার পার হতেই চোখে পড়ে সাইনবোর্ড। ঐতিহাসিক নীলকুঠি। রাতুল ঠিকই বলেছে। সাইনবোর্ডের নিচে তীর চিহ্ন দেওয়া। গাড়ি নিয়ে কিছু দূর যেতে চোখে পড়ে বিশাল আমবাগান।
নীলকুঠির কাছে এসে গাড়ি পার্ক করে আমরা নেমে পড়ি। জায়গাটা এখন প্রায় নির্জন। তবে রাতুল জানাল, পয়লা বৈশাখ-ঈদে এখানে বিশাল মেলা হয়। তখন প্রচুর মানুষ আসে আশপাশের গ্রাম থেকে। ওই সময় নাকি যাত্রা হয় এখানে।
‘তুমি কখনো যাত্রা দেখেছ?’ আমি জিজ্ঞাসা করি রাতুলকে।
‘আমি দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আব্বু-আম্মু দেখতে দ্যায় না। বলে এসব দেখা নাকি খারাপ!’ নয় বছরের ছেলের মুখে সিরিয়াস ধরনের কথা শুনে খুব মজা লাগে।
বিশাল বারান্দাওয়ালা নীলকুঠি মন ভালো করে দেয়। চারপাশে চমৎকার ফুলের গাছ। একজন কেয়ারটেকারকে কিছু টাকা দিয়ে রাতুলকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আমার স্মার্টফোন দিয়ে ছবি তোলাই রাতুলকে দিয়ে।
নীলকুঠির সামনে একটা শুকিয়ে যাওয়া নদী। নদীতে যাওয়ার সিঁড়ি আর দুই পাশে বসার জায়গা সিমেন্টের তৈরি। আমি আর রাতুল সেখানে বসে ফুরফুরে নদীর বাতাস খেতে খেতে পা দুলাই। কেয়ারটেকারের কাছে নদীর নাম জানতে চাই। সে বলতে পারে না।
চারদিকে সবুজ শ্যামলিমার মাঝে শুধু মনে হয়, সাঈদ পাশে থাকলে আরও ভালো লাগত। আমার মাথায় আসে না, এখানে আসার ব্যাপারে সাঈদের এত অনাগ্রহের কারণ কি! তেমন তো কিছু চোখে পড়ল না, যেটা ওর না আসার কারণ হতে পারে!
মনের মধ্যে খচখচে ভাবটা যায় না। রাতে শোয়ার সময় সাঈদের সঙ্গে কথা বলি না। ও যে আমার সঙ্গে নীলকুঠি যায়নি বলে রেগে আছি, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করি। সাঈদ বালিশে মাথা রেখে কোন ভূমিকা ছাড়া বলে ওঠে, ‘ জানত, আমঝুপির নীলকুঠিতে নানা পার্বণে যাত্রা দল আসত।’
‘আমি রাতুলের কাছে শুনেছি। তো কি হয়েছে?’ আমি সাঈদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠি।
সাঈদ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে, ‘ছোটবেলা রাত জেগে সেই সব যাত্রা দেখতে যেতাম। আব্বা-আম্মার নিষেধ থাকার পরেও ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম। তখন আমার বয়স রাতুলের চেয়ে দুই-তিন বছর বেশি হবে। সেই রাতে সবার সঙ্গে জেগে যাত্রা দেখেছিলাম। যাত্রাপালার নামটা এখন মনে নেই। সকালে উঠে শুনি, যাত্রা দলের প্রধান নায়িকাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে সন্ধ্যায় কাজলা নদীর ধারে তার লাশ পাওয়া যায়। ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছিল মেয়েটিকে। আগের দিন রাতে যাত্রায় গ্রামের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছিলাম মেয়েটাকে। সকালে দেখি মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত লাশ! ওই বয়সে ঘটনাটা মনের মধ্যে খুব ছাপ ফেলেছিল। এরপর আর কখনো নীলকুঠিতে যাইনি। কলকাতার নাটকে শরৎশশীকে দেখে অনেক দিন পরে দুর্ভাগা মেয়েটির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।’
সাঈদের কথা শেষ করে পাশ ফিরে শোয়। ঘুমিয়ে পড়ে কিনা জানি না। আমি অন্ধকারে চোখ মেলে শুয়ে থাকি। আমার অতি ইতিবাচক মন সহজে কোন নির্মমতার খবর নিতে পারে না। খুন আর ধর্ষণের খবর শোনার ভয়ে পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। সাঈদ হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এত দিন সময় নিয়েছে। এক সময় আমার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে অচেনা সেই শরৎশশীর জন্য। বালিশ ভিজে যায় সেই জলে।
জানালায় পর্দার ফাঁক দিয়ে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যায় না। এমন অন্ধকারেই শ্বাপদেরা শিকার খুঁজতে বের হয়।