ইসরায়েলকে নিয়ে মার্কিন রাজনৈতিক বিতর্কে পরিবর্তন আসছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বহু যুগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দল প্রায় শর্তহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে আসছে।

সব সময় বলা হয়েছে, ইসরায়েল নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিতর্কে সব সময় ফিলিস্তিনিদের হামলাকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রধান প্রধান মার্কিন গণমাধ্যমও ইসরায়েল আত্মরক্ষার্থে হামলা পরিচালনা করে বলে ফলাও করে প্রকাশ করে আসছে।

আরও পড়ুন

এবারে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিতর্কে নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার তিনি সমর্থন করেন। তবে এবারে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। মার্কিন প্রশাসন এ যুদ্ধবিরতির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে। ইসরায়েলকে যুদ্ধ বিমান সরবরাহ করে প্রতিপক্ষের ওপর আকাশ থেকে হামলার শক্তি বৃদ্ধির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি গাজা উপত্যকায় বর্ধিত মানবিক সাহায্য বৃদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজার রাস্তায় নেমে আসেন ফিলিস্তিনিরা
ছবি: এএফপি

২১ মে থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এবারেই প্রথমবারের মতো দেখা গেছে, ডেমোক্রেটিক দলের উদারনৈতিক পক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক নাগরিক আন্দোলনের লোকজন প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিকদের এবারে সরব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। ডেমোক্রেটিক দলের অভ্যন্তরেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানাতে চাপ প্রকাশ্য হয়েছে।

মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির এ পরিবর্তনের পেছনে দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর (এনপিয়ার নিউজ) রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসমা খালিদ তাঁর বিশ্লেষণে বলেছেন, সাম্প্রতিক নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মার্কিন উদারনৈতিকদের ওপর বৈষম্য ও বিদ্বেষ-বিরোধী মনোভাব এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের প্রিয় পাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে উদারনৈতিক মার্কিন লোকজনের সঙ্গে ইসরায়েলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

আরও পড়ুন

ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলকে নিয়ে একটি পক্ষকে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা এ পক্ষটি মনে করে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যথেষ্ট নয়। তাঁদের মতে, ডেমোক্রেটিক দল ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে এখন ভাবতে হবে।

বারাক ওবামা প্রশাসনের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা বেন রোডেস
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সানরাইজ মুভমেন্ট নামের উদারনৈতিক নাগরিক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ভার্সিনি প্রকাশ বলেছেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যথেষ্ট হতে পারে না। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে এবং মার্কিন সমর্থন এ রক্তাক্ত সহিংসতাকে বেগবান করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং মার্কিন কংগ্রেসের নেতৃত্ব একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বলছেন, অন্যদিকে নিষ্পাপ সাধারণ মানুষ ও শিশুদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করাও হচ্ছে।

আরও পড়ুন

সানরাইজ মুভমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে আন্দোলনরত যুব-তরুণদের শক্তিশালী সংগঠন। এ সংগঠনসহ ১৪০টি উদারনৈতিক নাগরিক সংগঠন গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলার সরাসরি নিন্দা জানানোর জন্য মার্কিন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা বিবৃতিতে ফিলিস্তিনকে জোরপূর্বক বসত ভিটা থেকে উচ্ছেদের জন্য দায়ী করেছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন বেন রোডেস। তিনি বলেন, এটা সত্য যে ওবামা প্রশাসনের সময়েও যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এমন কোনো চাপ আসেনি; যা এবারে এসেছে এবং মার্কিন উদারনৈতিকদের এ সোচ্চার অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়েছে আল জাজিরা ও এপিসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কার্যালয়
ছবি: রয়টার্স

বেন রোডেস বলেন, ডেমোক্রেটিক দলে এখন মতাদর্শের অনেক ভিন্নতা চলে এসেছে। ইসরায়েলকে নিয়ে দলটি পুরোনো অবস্থানে টিকে থাকার এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি মনে করেন। এনপিআর নিউজের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানতেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান এবং ইসরায়েলি হামলার সরাসরি প্রতিবাদ না জানানোর পরিণামে দলের উদারনৈতিক পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া আসবে। ২০১৪ সালে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের উত্তেজনা নিরসনের মতো নেপথ্যের কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ওবামা প্রশাসনে কাজ করেছেন এমন বেশ কিছু কর্মকর্তা এখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনে কাজ করছেন। এবারেও তাঁরা নেপথ্যের কূটনৈতিক তৎপরতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের যুব-তরুণ নাগরিক আন্দোলনের লোকজন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্বকে ক্ষমতা আর দখলদারির দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখে। নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক ইভান ওয়েবনার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রজন্ম ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়কে এক চোখে আর দেখে না। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের মতো একটি সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সমাজে ও চিন্তায় আজ আমূল পরিবর্তন ঘটছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ছবি: রয়টার্স

‘মুভ অন’ নামের উদারনৈতিক নাগরিক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক রাহনা এপ্টিং বলেছেন, আমরা তথ্যের অবাধ প্রবাহের মধ্যে আছি। পিতার কোলে নিহত শিশুর ভিডিও এখন সরাসরি ফিলিস্তিন থেকে দেখার সুযোগ আছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে আগের মার্কিন নাগরিক মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে তিনি মনে করেন।

মার্কিন রাজনীতিতে উদারনৈতিকদের উত্থান ঘটছে। প্রতিনিধি পরিষদের রাশিদা তালিব, ইলহান ওমর, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ ও আয়ানা প্রিসলি প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন ফিলিস্তিনের পক্ষে। তাঁরা ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বন্ধের জন্য প্রতিনিধি পরিষদে আইন প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। এসব আইনপ্রণেতারা প্রকাশ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিপক্ষে বলছেন এবং ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি তাঁদের সোচ্চার সমর্থন উচ্চারিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থানও মার্কিন রক্ষণশীল আশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে রিপাবলিকানদের আমন্ত্রণে ওয়াশিংটনে আসেন এবং তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির কড়া সমালোচনা করেন। ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যে ইসরায়েলিরা সম্ভাবনা না দেখে এখন রিপাবলিকান দলকেই তাদের বিশ্বস্ত মিত্র মনে করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলেছেন, ইসরায়েলের ওপর কোনো হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত ইসরায়েলের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানাবে এ কথা স্পষ্ট করলেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে।

কয়েক দিন ধরে ফিলিস্তিনে বোমাবর্ষণ করে চলেছে ইসরায়েল। বোমা হামলার পর আল শিফা হাসপাতালে এসেছে এই ফিলিস্তিন পরিবার। গাজা, ফিলিস্তিন, ১৬ মে
ছবি: এএফপি

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ইসরায়েল নিয়ে মার্কিন অবস্থান ‘হয় তুমি আমাদের সঙ্গে আছ, না হয় বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছ’ নীতিতে চলেছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—এ দুই দেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে কোনো সমঝোতা রিপাবলিকান বা ট্রাম্প সমর্থকদের কাছে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের পুরোনো সদস্যদের মধ্যে এখনো ইসরায়েল প্রীতি শক্তিশালী। এ পরিস্থিতি থেকে মার্কিন উদারনৈতিক সমাজ বেরিয়ে আসছে এবং নতুন উদারনৈতিক প্রজন্মের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মার্কিন নাগরিক মনোভাবের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যে উদারনৈতিক পক্ষ শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন মনোভাবে পরিবর্তন ঘটবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

আরও পড়ুন