একজন শহীদ কাদরী
বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আস্তে আস্তে সূর্যটাকে ঘিরে ফেলেছে মেঘ। যেন তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ার। সূর্যও তাদের সেই সুযোগ করে দিয়ে আস্তে করে ডুবে গেল। ঝিরিঝিরি বাতাস দোলা দিয়ে গেল। মেঘেরা কাঁদতে শুরু করল, নেমে এল বৃষ্টি। আমিও পৌঁছে গেলাম কবি শহীদ কাদরীর নিউইয়র্কে জ্যামাইকার বাসায়।
এই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। একটু ভয়ও কাজ করছিল। এত বড় একজন কবি। আমার সেই ভয়কে দূর করে তিনি সহজ ভাবেই বলে উঠলেন, ‘হ্যালো ফারজানা কেমন আছ? ইকবাল আমাকে বলেছে তুমি আসবে। ইকবাল আসেনি?’ বললাম এসেছে। যার মাধ্যমে আমি কবির বাসার ঠিকানা পেয়েছিলাম এবং আমাকে যিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি ইকবাল।
সময়টা ছিল ২০১২ সালের জুলাই মাস। কবি অসুস্থ ছিলেন, দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কবির কথা শুনে একটুও মনে হয়নি তিনি অসুস্থ। তবে টেবিলের ওপর রাখা ওষুধগুলো বলে দিচ্ছিল তাঁর অসুস্থতার মাত্রা। প্রশ্ন করলাম এত ওষুধ কার?
—মুচকি হেসে বললেন, আমার। এরাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওষুধের পাশে বই আর বই। বোঝা যায় তিনি প্রচুর পড়েন। তাঁর পাশেই বসলাম। শুরু হলো গল্প। খুব অবাক হয়ে শুনছিলাম তাঁর কথা। কী তীক্ষ্ণ স্মৃতি। বলছিলেন তাঁর সেই কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার কথা। এরপর কীভাবে বিদেশ এলেন। কত সহজ সাবলীল ভাবে বলছিলেন, যেন চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভাসছে।
এরপর বললেন, কী খাবে বল? কফি না চা? ডাইনিং টেবিলের ওপর অনেক ফল ছিল। নীরা ভাবি বললেন, কোনটা পছন্দ বল? আমার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু গল্প করতে ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এত প্রাণ ভরে গল্প করি না অনেক দিন। ভাবিকে বললাম, কিছু খাব না, বরং গল্প করব আপনাদের সঙ্গে।
জীবন বোধের বহুমাত্রিক আঙিনায় বিচরণ ছিল তাঁর। যা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে, খুব বেশি লেখেননি। এই অল্পসংখ্যক কবিতায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। তাঁর লেখায় কবিতা পেয়েছিল নতুন এক নতুন ধারা। কবি একজন মেধাবী, বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। তাঁর ক্ষুরধার ভাবনা যেন প্রতি কবিতায় কবিতায়।
‘ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করব
বন-বাদাড় ডিঙিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।’
(তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা)
প্রখর চিন্তাশক্তির এই মানুষটির অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল। যে কাউকে দেখেই তাঁর সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতেন। ওই ধারণা খুব একটা ভুল হতো না। বন্ধুবৎসল স্বভাবের মানুষটি আড্ডা দিতেও পছন্দ করতেন।
সেদিন অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল, কবিতা নিয়ে, গল্প নিয়ে। আমার কিছু লেখা দেখালাম। পছন্দ করলেন খুব। বললেন, তুমি নিয়মিত লেখ না কেন? যদি চর্চা চালিয়ে যাও অনেক দূর যেতে পারবে।
বাইরে তখন ঝড়। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ভাবছ? চিন্তা কর না নীরা তোমাকে পৌঁছে দেবে। প্রশ্ন করেছিলাম, দেশে যাবেন না? যেতে ইচ্ছে করে না? উল্টো আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কবে দেশে যাবে? বললাম, যাবেন আমার সঙ্গে? হ্যাঁ যেতে পারি। ভালো হবে, গল্প করতে পারব আর যেহেতু তুমি লেখালেখি জগতের মানুষ আমার জন্য ভালো হবে। নীরাও একজন সঙ্গী পাবে।
বললাম, আমাকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? এই প্রথম আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়। যদিও আমি আপনাকে অনেক আগে থেকেই চিনি, কিন্তু আপনি তো আমাকে চেনেন না। হেসে উঠলেন কবি। খুব সহজভাবে বললেন, আমি তোমাকে পড়ে ফেলেছি। কিছু মানুষ আছে তাদের খুব কাছের মনে হয়, আপন মনে হয় প্রথম দেখাতেই। তুমি তাঁদের একজন। নীরা ভাবি পাশেই ছিলেন। তিনি বললেন, ফারজানা কবি ঠিক কথাটাই বলেছে, তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে তুমি আমারও অনেক দিনের চেনা। সত্যি যদি দেশে যাও জানিও আমাদের। এভাবেই চলছিল কথামালা। রাত প্রায় তখন ১১টা হবে। অত রাতে নীরা ভাবিই আমাকে পৌঁছে দিলেন জ্যামাইকায় আমার ননদের বাসায়।
সেদিন এতটা আশা করিনি। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বরং বেশি আপ্যায়ন করেছিলেন কবি ও তাঁর স্ত্রী নীরা ভাবি।
২০১৩ সালে দেশে গিয়েছিলাম, ফোন করেছিলাম কবিকে। তখন তিনি আরও অসুস্থ ছিলেন। বললেন, হয়তো আমার আর যাওয়া হবে না। পরে কবিকে আরও একবার দেখতে গিয়েছিলাম। তবে সেবার এত প্রাণবন্ত ছিলেন না। মনে হচ্ছিল তাঁর সময় বুঝি ফুরিয়ে আসছে। সত্যি তিনি আর বেশি দিন ছিলেন না। ২০১৬ সালে ২৮ আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দেশে তিনি গিয়েছিলেন ঠিকই, তবে কফিনে মোড়ানো অবস্থায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন দেশে যাওয়ার সব খরচ বহন করে। একজন কবিকে যথাযথ সম্মান দিয়েছিলেন। কবির জীবনের বেশির ভাগ সময় প্রবাসেই কেটেছে। জীবনের শেষের দিনগুলো নিউইয়র্কের জ্যামাইকার বাসায় কাটিয়েছেন স্ত্রী নীরা কাদরীর সঙ্গে।
১৪ আগস্ট মাসেই কবির জন্মদিন। আর এ মাসেই আমরা হারিয়েছি অন্যতম কবি শহীদ কাদরীকে। আগস্ট মাস এলেই ভয়ে থাকি। কি যেন অপছায়া ঘিরে থাকে এই মাসকে। এই মাস শোকের মাস। এই মাসেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল এ মাসের ২১ তারিখেই।
কবি শহীদ কাদরী স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। বলতেন মনকে প্রশ্ন কর কী চাও, উত্তর পেয়ে যাবে। তাঁর লেখার ধরন ছিল একটু ভিন্ন মাত্রার। যেমন—
‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না।’
কবির কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি ছিল। বলতেন কিছুই তো লিখিনি। মন যখন বলেছে লিখতে, লিখেছি। আবার যখন লিখতে ইচ্ছে করছে না, থেমে গেছি।
কবিতা জীবনের কথা বলে আর কবি তাঁর প্রতিটি শব্দ দিয়ে বুনে গেছেন হৃদয়ে ধারণ করা কবিতা। কবি, ভালো থাকুন ওপারে এই কামনা করি।