কবিতার এক পাতা
‘সকলেই কবি নয়, কেউ-কেউ কবি’। জীবনানন্দের এই যে মন্তব্য, জানতে আমাদের কৌতূহল হয়, এর অর্থটা ঠিক কী । তিনি কি কবি ও পদ্যকারদের দুই পৃথক এলাকার অন্তর্ভুক্ত করে দেখাতে চান ? নাকি, শুধুই পদ্যকার নয়, সর্বজনের থেকে আলাদা করে দেখাতে চান কবিদের?
কবিরা অবশ্যই অন্যদের থেকে পৃথক গোত্রের মানুষ, কিন্তু তাঁরা নিজেরাও কিছু একে অন্যের সগোত্র নন। রবীন্দ্রনাথ আর মাইকেল কি একই গোত্রের কবি? কিংবা ধরা যাক, জীবনানন্দ আর বুদ্ধদেব? আসল কথা, যাঁদের আমরা কবি বলে জানি, শব্দ রুচি, বিষয়বস্তু, বর্ণনা রীতি, বাকভঙ্গি ইত্যাদি অসংখ্য ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে যৎপরোনাস্তি বৈষম্য থাকা সম্ভব এবং সেটা থাকেও। ( নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গ্রন্থ: কবিতার কী ও কেন)
আমেরিকা ও কানাডার সাতজন কবির কবিতা নিয়ে চলতি সংখ্যা ‘কবিতার এক পাতা’র আয়োজন। এবারের আয়োজনে যেমন লিখেছেন বাংলাদেশের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি, স্বনামখ্যাত তরুণ কবি, লিখেছেন প্রতিশ্রুতিশীল নবীন কবি। পড়ার জন্য বিনীত আমন্ত্রণ। উত্তর আমেরিকায় এই শীতার্ত দিনে আমাদের হৃদয়ের উষ্ণতা মাখা ভালোবাসা নেবেন।—ফারুক ফয়সল
এ-সব সরল-গরল
মাহবুব হাসান
১.
তুমি সরল অংশের মতো জটিল মেয়ে
একবার ভাগ করো তোমার হৃদয়
আরেকবার গুণের তর্কে নেমে বিচার করো
তোমার মানবিক ইচ্ছার কণা!
যোগ আর বিয়োগের দ্বৈরথে চলে
পৃথিবীর ভালোবাসা!
২.
শব্দের গতি কী?
এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইলকে ভাগ করো
মনে মনে,
মনকে তোমার ইচ্ছার বাতাবি লেবুর রসে ভিজিয়ে
রাখো আরও কয়েক শতক,
আলো আর শব্দের সহযোগে
যোগ আর বিয়োগ চলতে থাকে আজীবন,
এই ঘোর থেকে তোমাকে আলাদা করতে পারো না!
কেন না ওই খেলা চাউল আর কাকরের নয়,
এ খেলা ছেলেবেলার সরল অঙ্ক!
বিশ্বাসের তর্কে রাঙা।
৩.
তুমি এতই সুন্দর যে রহস্যও আজ বাক্-হারা!
তুমি এতই সুন্দর যে জটিলও সরল অঙ্ক
তুমি এতটাই সুন্দর যে প্রগাঢ় সত্যও তর্কে নিমজ্জিত!
তুমি এতটাই সুন্দর যে ভার্চুয়াল পৃথিবীর মতো অধরা,
তোমার সৌন্দর্য কী দিয়ে সমাধানে যাব হে?
৪.
আমাদের শৈশবকাল ছিল রহস্যের জালে বোনা,
আমাদের যৌবনকাল কেটেছে রাজনৈতিক ঘোরে,
শোল আর বোয়াল মাছের মতোই সে সব স্বপ্ন
শাদা-কালো আকাশের নীল
অসীম অধরা!
বিস্ময় শব্দটিকে তুমি এখানে সেঁটে দিতে পারো
কারণ বিস্মিত হতে চাও রহস্যের আঁচলে।
ভালোবাসাই একমাত্র জটিল সরল অঙ্ক!
দ্বয় ও অদ্বয়
মাসুদ খান
দুই পাশে দুই পাড়ই কেবল, একই স্রোতস্বতী।
ধ্রুবক যেমন বিধান করে চলকের সুগতি।
অদ্বয়, সে তো দ্বয়ের অপর
রূপ ঝলমল ভাবের শহর
অদ্বয় যে হয় চিরদিনই দ্বয়ের পরিণতি
দুই পাশে দুই পাড়ই কেবল, একই স্রোতস্বতী।
সহজনম, সহযাপন
যাপন শেষে সহমরণ
একসঙ্গেই দীর্ঘ ভ্রমণ, নেই কোনো ছেদ যতি।
দুই পাশে দুই পাড়ই কেবল, একই স্রোতস্বতী।
জ্যান্ত দেহে শান্ত দাফন
দেহপ্রান্তে নতুন কাঁপন...
চলক যে চায় ধ্রুবক হতে—এমনই দুর্মতি!
দুই পাশে দুই পাড় রয়েছে, একই স্রোতস্বতী।
বেজে যায় সন্ধ্যার ব্লুজ
রাকীব হাসান
এক.
যেখানে যাওয়া যায় না
সেখানে পৌঁছে জানালাম,
না গেলেও হতো
কেন শূন্যতায় এতটা দূরে হাঁটলাম?
সহসা একদিন পায়ের আঙুল ধরে
হাতের আঙুল টের পায়,
প্রতিদিন দীর্ঘতম সন্ধ্যায়
অন্ধকারের আগে যে অন্ধ হয়ে যায়,
সে আমার ভেতরে
দেহ দিয়ে একা একা মরে গেছে এক ঘরে।
নৈঃশব্দ্যের বরফ জলের ক্ষয় না,
হাতঘড়ির শাসনে রক্তে অভ্যস্ত বংশধর
ছিল জল ও শেওলায় পরস্পর
কত সব আলিঙ্গনে মনের আর স্পর্শ হয় না
দুই.
কোনো শব্দ ছাড়াই শব্দ জমা হয়
যেই মাত্র মাত্রা ভাঙি,
ভালোবাসার বিমূর্ত ব্যাংকে জমে যায় জল।
প্রতিদিন, এক জীবনের দিন দিয়ে দিই,
বেজে যায় সন্ধ্যার ব্লুজ
ঘুমিয়ে যায় পাড়া গাঁ, সারা গা।
জড়িয়ে আছে অন্ধকারে কাঠের আঁশ
তাকে আলগা করে দেখি
আমি আর জাগাতে পারি না ঘুম,
একটা পাহাড় হলে ভালো—তাকে শুধু দেখা যাবে,
দূর থেকে বোঝাই যাবে না—জীবিত না মৃত!
পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত
ফেরদৌস নাহার
তারা সংসার বিজয়ী, তারা ঘোড়সওয়ার
ছুটে-চলা দিনে বুনোপাতার ঘরে
তাদের ঘুম আসে
তারা ঘুমিয়ে পড়ে
স্বপ্নে এক এক করে গুনতে থাকে
ব্যাধি ও ব্যাধের পরিমাণ
যেখানে বাজে মধ্য রোদের অর্গান
তিহার জেল থেকে মুক্তি পাওয়া কাফেলা
চলেছে পাগলাগারদের দিকে
টুং টাং ঘণ্টারা ঢং ঢং বেজে ওঠে
জগৎ সংসার খান খান হয়ে যায়
কালো চশমা চোখে সক্রেটিস ঘুরে মরেন
এথেন্সের বাজারে
বটতলার পুঁথি
মুজিব ইরম
সেই কবে লেখা হলো জানে দু’জাহান। শোনো তুমি শোনো কন্যা সেই সে বাহান॥ তোমার রূপের কথা কেমনে বলিব। দোভাষী পুঁথির টানে হয়তো চলিব তোমার সুরেলা গ্রীবা একটু বাঁকিও। শায়েরি পুঁথির মানু আমারে ডাকিও॥ আমি তো তোমার রূপ দেখি ঘরেবারে। প্রচার করিব রূপ বাজারে বাজারে॥ না হয় কিছুটা তুমি চোরা হাসি হেসে। আসিও জলের ঘাটে পাঠকের বেশে॥ কটাক্ষ করিও তুমি ঠিসারা করিও। নিদানের কালে তুমি এ-হাত ধরিও॥ গোপনে প্রকাশ্যে কন্যা আমারে টেরিও। তোমার বিনাশী চোখে আমারে হেরিও॥ গোপনে কইও কথা জগতে বিরল। এই ভাষা হয় যেন অতীব সরল। তোমার রূপের কথা কী কহিব আর। তুমি কন্যা সর্বনাশী রূপের বাহার॥
তুমি কন্যা রূপবতী ত্রিপদী গড়ন। ধরিতে দিও গো কন্যা পয়ার চরণ॥ ইরমে শায়ের পুঁথি না লিখিবে আর। এমত রূপের কিচ্ছা লিখে সাধ্য কার॥
ফরাসি সুন্দর শহরে হেমন্তের পাতা
অপরাহ্ণ সুসমিতো
: ডেথ অ্যান্ড দ্য মেইডেন নাটকটা দেখেছ?
: মুখোশ?
: সৈয়দ হকের অনুবাদ। নাগরিক করেছে।
: না দেখিনি, তুমি?
: দেখলাম কাল। সারা জাকের নির্দেশনা দিয়েছেন। অসাধারণ প্রোডাকশন।
: মিস করলাম। তুমি একা আমাকে ফেলে দেখে ফেললে?
: কি করব বলো? তুমি আজকাল পাল্টে যাচ্ছ।
: আমি? কেন এ রকম বলো,বলো তো? বুকে লাগে।
: তোমার বুক আছে নাকি?
: নেই? বুক আমার বাংলাদেশের হৃদয়।
: থাক কাব্য করবা না। ফাজিল
: মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।
: হইসে। মুনীর চৌধুরীর রেফারেন্স লাগবে না।
: চুমু করো।
: চুপ। চান্স পেলেই...
: আচ্ছা থাক। এই শরতে আর চাইব না।
: চাইলেও পাবা না। গান শুনবা?
: আমার মনের কোণের বাইরে...
: জানো এসএসসির আগে মা গান শেখানো বন্ধ না করলে এতদিনে...
: ভালো হইসে। বড় শিল্পী হলে তো এখন আর তোমার নাগাল পেতাম না।
: শোনো ছোটবেলায় আমার খুব মন খারাপ থাকত, কোথাও যেতে চাইতাম না।
: কেন কেন?
: খুব রাগ হতো। আমার গায়ের রং বাবার মতো কেন কালো হলো। সব জিদ বাবার ওপর দেখাতাম।
: আশ্চর্য !
: সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতাম। বাবা খুব কষ্ট পেতেন। বলতেন: মা,আমি কী করি বল? কেন যে তুই তোর মায়ের রংটা পেলি না!
: আমি ভাবতেই পারছি না এ রকম তুমি করতে
: গায়ের রং নিয়ে আমার সারাক্ষণ কমপ্লেক্স। সব বান্ধবীদের ছেলেবন্ধু আছে, আমার ছিল না। হু হু করত...
: থাক ওসব দিনকাল। পেছনে ফেলে আসি...গানটা করো প্রিয়ংবদা
ফরাসি সুন্দর শহরে হেমন্তের পাতা ঝরে পড়ে সেপ্টেম্বরে। আমি গান শুনতে থাকি ফোনের ইথারে। আমার মনের কোণের বাইরে...
কী যে মমতায় ভাসতে থাকে দুটো শহর দুই প্রান্তে...
মানুষ এবং ধার্মিক
হাবিব ফয়েজি
ঘর থেকে বের হলেই বেশির ভাগ সময়
ধার্মিকদের সঙ্গে দেখা হয় আমার
দেখা হয় একেকজন পাক্কা ব্যবসায়ীর সঙ্গে
কাজের জায়গায়, চায়ের আড্ডায় কিংবা
যেকোনো অনুষ্ঠানে
অথচ কি আশ্চর্য!
খুব কম সময়ই দেখা হয় মানুষের সঙ্গে...
শুধু ধর্মগ্রন্থ পড়ে ধার্মিক হওয়া যায় না
বড়জোর ধর্ম ব্যবসায়ী হওয়া যায়
সত্যিকার অর্থে—
ধার্মিক হওয়ার আগে মানুষ হতে হয়
অবশ্য দ্বিন আর ধর্মের পার্থক্য যারা বোঝে না
তারা কীভাবে বুঝবে মানবতাই যে মানবধর্ম ।