কবিতার এক পাতা

>সৃজনশীল আত্মমগ্ন নিমগ্নতা একজন কবির অন্তর্গত স্বভাব। কবিতা লেখা কিংবা যথার্থ কবি হতে চাওয়া একটি সার্বক্ষণিক কাজ। চেতনে–অবচেতনে সবটা সময় তিনি ভাব বিভোর থাকেন শব্দ ও সৌন্দর্য সন্ধানের মগ্নতায়।
তবু সত্য এই যে, কবি পরিবার, সমাজ বিচ্ছিন্ন একা একক কোনো সত্তা নন। তাঁর জীব ধর্ম আছে, পরিবার আছে, দায়িত্ব আছে। তাই তাঁকেও জীবিকার আশ্রয় করতে হয়। কবিতার জন্য সময় দান তাঁর জন্য মহার্ঘ হয়ে পড়ে । হঠাৎ করেই করোনা মহামারি অন্য সবার সঙ্গে তাঁকেও ঘরবন্দী করে ফেলায় কবি প্রচুর সময় পেয়েছেন। প্রাণ ভরে লিখবেন। কিন্তু পারছেন না। অন্য সবার মতোই বাইরের জগতের নিরানন্দ, সম্মিলিত ক্রন্দন, হতাশা তাঁকেও কাবু করে রাখছে। তারপরেও কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। মাথায় করোনা যন্ত্রণা, তারই ছাপ কবিতায়।
করোনা ক্রান্তিকালে দাহ ও কষ্টকালের চিহ্ন ধারণ করে উত্তর আমেরিকা ও বাংলাদেশের আটজন কবির আটটি কবিতায় মে সংখ্যার
‘কবিতার এক পাতা’র আয়োজন।
কবিদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। আপনাদের সবার জন্য এক বুক ভালোবাসা—ফারুক ফয়সল

ইকবাল হাসান

এমন দহন দিনে

(হাসনাত আবদুল হাই শ্রদ্ধাস্পদেষু)

ছোট হতে হতে জীবন এখন সমুদ্রপাড়ে ছিপিযুক্ত
বোতলের ভেতর নাবিকের আটকে পড়া ভয়ার্ত অবয়ব !
এখন ঘর বলতে শুধুই বারান্দা , বেডরুম, খাবার টেবিল
আর বিছানা..বালিশ...., ছাইপাঁশ গেলার সেসব সুদিন
কবেই হয়েছে গত, রোজ গার্ডেনে প্রতিটি বিকেল যেন
বৈধব্যের পোশাকে শুয়ে থাকা মধ্যরাত ! এখন আড্ডা
মানে ফোন আর ফেসবুক। কত দিন তোমাকে দেখি না !
তবু রক্ষে, ইউ টিউব, জুম লাইভ আছে বলে ..., তবু রক্ষে
কিছু মুখ উঁকি দেয় প্যারিসের জানালায়, ‘কলকাতা রানাঘাট’,
কফি ও কবিতায়। যদিও এখন ঘর মানে চিলেকোঠা, আর
নিসর্গ মানে জানালার বাইরে ওই একটুকরো মলিন আকাশ
যতটুকু দেখা যায়- দেখি, শুধু কত দিন তোমাকে দেখি না !

কামরুল হাসান

করোনা নয়, জিতবে মানুষ

যুদ্ধবিমানগুলো আজ পৌঁছে দিক ত্রাণ,
ট্যাংকের পেট থেকে ছড়াক ভাতের ঘ্রাণ।
দেখ এসব কামানে ভরে না ক্ষুধার্ত প্রাণ,
অহেতুক ওই সব মিসাইল সতর্ক, টান টান।

এসেছে উহান থেকে যে মিটমিটে শয়তান
পালাবার পথ রাখেনি খুলে চৈনিক মাস্তান;
বোলোগনা থেকে প্যারিস ঘুরে দূর মিশিগান
সারা পৃথিবীতে ছড়ায় বিষ, আজ বিপন্ন ম্যানহাটন।

বিপন্ন আজ সভ্যতার সিঁড়ি, বিপন্ন প্রিয় মানবতা
জড়িয়ে ধরেছে ভয়াল শত্রু এ যে তীক্ষ্ণ মরণলতা,
আমরা যদিও লুকিয়েছি ভয়ে সকলেই হারব না
এই যে বিপুল গড়েছি পৃথিবী, তাকে ছাড়ব না।

তাই তো দেখি সোনার ছেলেরা ফ্রন্টে যায় প্রতিদিন
বন্দুক নয়, ওদের হাতে থার্মোমিটার দোলে রঙিন
করোনাদৈত্য বধ হবে জানি করুণ ও সঙ্গীণ
জীবন বাঁচাতে লড়ছে যারা হবে না কখনো মলিন।

আরেক দল খাবারের থলি পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে
হাসপাতালে পৌঁছে দেয় যারা পড়েছে হঠাৎ জ্বরে
সকলে মিলে বাঁচি বলে এই প্রকৃতির অভিশাপ
ছেড়ে যাবে পৃথিবীর কোণ, নেমে যাবে ভয়, তাপ।

শিবলী মোকতাদির

ঝড়

কাশবন আজ তাড়িয়ে দিল আড্ডা চা’য়ের থেকে
কোন বাহানায় চলবি এবার রাস্তা গেছে বেঁকে
মালিক তোমায় পুষবে না আর চাকরি থেকে ছাড়
নর্দমাতে নজর দেবে- যে কুড়াবে তার।

ঘুম ভেঙে যায় রাত ফেটে যায় দৈত্য আসে তেড়ে
ভয়ের মাঝে ভ্রান্তি বলে- জয় করো ঈশ্বরে
এমন তুমি জটিল তুমি ভিন বাতাসে উড়ে
ওই প্রদেশে প্রেমিক মারো আমরা অনেক দূরে।

বৃষ্টিতে হয় বন্দী যারা লকডাউনে ছাড়ে
আকাশ থাকে জাগ্রত আজ পাখির অধিকারে
আমরা ডুবি আমরা ভাসি ক্লান্ত জনপদ
চক্রাকারে লুটছ তুমি সমস্ত সম্পদ।

মড়ক লাগে চারায় চারায় বাড়ছে দেহে তাপ
মহামারির মাত্রাতে আজ লাগাচ্ছ সংলাপ
তাপ বেড়ে যায় গা পুড়ে যায় হচ্ছি নিথর হায়
মৃতের বুকে মৃত্যু এসে বিদ্যুৎ চমকায়।

মানুষ ছোটে আলোর মতো নির্দেহ তেজ নিয়ে
ঘনক থেকে ছিটকে গিয়ে হচ্ছি একক দিয়ে
অভিজ্ঞানে অশেষ থাকে তোমার সম্মানে
এই কারাগার ভরছে সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানে।

এই বাড়িতে সেই পাড়াতে অপূর্ব সেই লোক
শৌর্য, বীর্যে বন্দী থেকে দীর্ঘজীবী হোক
রাত বাড়ছে তীব্র বেগে ঘুরছে কোভিড বায়ু
চা’য়ের কাপে ঝড় থেমে যায় যাচ্ছে কমে আয়ু!

মুজিব ইরম

বাড়ি

সহজ করে লিখছি বসে কঠিন করোনায়, এ দুটি চোখ ফের যেন হায় তোমার দেখা
পায়।

যেমন করে নৌকা ভাসে নতুন পানি পেয়ে, ফরসা জলে তৈরি করে ঢেউ, জলের নিচে
দেহ নাড়ায় জলের সবুজ ঘাস, মাছগুলো সব সাঁতার কাটে খুব গোপনে, জোড়ায়
জোড়ায়, শান্ত হাওয়া বয়, তেমন করে পড়ছে মনে, তেমন করে ভাসছে মনে,
থাকছি বসে চুপ, তোমারও কি আমার কথা পড়ছে মনে খুব !

মনে রেখো মনে রেখো লিখছি বসে রোজ, ও পাতা গাছ সময় করে একটু নিয়ো
খোঁজ । একটু না হয় জানিয়ে দিয়ো তোমার আমি হই, বাড়ি ছাড়া হলেই বুঝি
বাড়ি ছাড়া হই !

খলিল মজিদ

বসন্ত শেষে

বসন্ত যেদিন সংক্রামিত হলো
গোলাপেরা পেল চতুষ্পদের প্রথা
বাতাসে ছিল মনস্তাত্ত্বিক ব্যথা
বসন্ত শেষে সহে না পুরোনো কথা।

ঠাকুমা’র ঝুলি থেকে বের হলো দৈত্য
আরবিশু দিনে আসছে অতিথি ঘোড়া
শহরের সব মোসাহেব ইঁদুরেরা
দাঁড়িয়ে পড়েছে হাতে পুষ্পের তোড়া।

অতি তেজস্ক্রিয় এই মিথ্যা প্রশংসায়
কাটা পড়ে গেছে ইঁদুর প্রজাতির কান
এসেছে গোলাপি কাঁটাঅলা কেউকেটা
পলায়নপর যত ভিখিরির গান।

তাহার ভীষণ সম্ভাষণের তাপে
মোমবাতিগুলো গলছে গোরস্থানে
আতঙ্কিত আসন্ন গ্রীষ্মকাল
সন্দেহজনক জুঁইফুল সবখানে।

করুণা করো না- করোনার কাঁটা থেকে
স্মৃতিগুলো গেছে বাণ প্রস্থের পথে
পুরোনো ব্যথা ভুলে যাওয়ার শূন্যতা
বসন্ত শেষে ফিরে আসে মনোরথে।

সেঁজুতি বড়ুয়া

দম আটকে যাওয়ার মতো

এ শহরে চাঁদ ওঠেনি আজ
তাই কালো, দম আটকে
যাওয়ার মতো

গুটিসুটি মেরে বসে আছি
মায়া ঘরে—- আশ্চর্য মৌনব্রত

মায়া ঘর, এক আঁজলা হাওয়া
দাও না সতেজ?
নিঃসঙ্গতায়, দরজা বন্ধ করে বাঁচি

কুয়াশার বিকলাঙ্গ হিমে— ক্যামন
গুমোট ঘ্রাণ বুকের সমান্তরালে হাঁটে
এক আঁজলা কান্না দিয়ো, শীতল
এক আঁজলা দুর্ভাগ্যের সঙ্গেও!

প্রকৃতিও, অন্ধকারে ডিপ্রেশনে ভোগে
ব্যথায়— বৃষ্টি নামায় যখন
পোড়ে বৃক্ষ নরোম দেহ
জানলা খুলি না, মৃত দেবদারুদের শোকে
জ্বর আসছে, অযথা কাঁপছি
একটা বুনো বুনো ঘ্রাণ করুণাবশত
শ্বাসকষ্টে ঢালে— ঘন মৃত্যুর সুধা!

রওশন হাসান

অণুজীবকাল

দিনের প্রারম্ভে সকাল বেজে ওঠে মুহুর্মুহু
জানালা কেঁপে ওঠে নিজস্ব দিনলিপিতে
জনশূন্য স্ট্রিট, অ্যাভিনিউ, কফিনের যান
ক্ষিপ্র গতিতে তীব্র সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলো
কিছুক্ষণ পর পর জানান দেয় জরুরি অসুস্থতা
পৃথিবীর আকাশে নব ঋতুর আগমন
চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঝরছে বসন্তের কচি পাতায়
বৃক্ষ-পাখিদের আতঙ্কহীন দিন
অবাধ বিচরণে যে মানুষেরা লিখেছিল মৃত্যুহীন আমলনামা
আজ তারা নিয়েছে ঠাঁই অন্তরীণ শোকের আগুনে
চিরবিচ্ছেদে নিশ্বাস বিষদাহে পৃথিবী থেকে নিয়েছে বিদায়
সব কথা হারিয়ে সনদে মৃত্তিকার কালো ফুল
প্রিয় কেউ হাসপাতাল ঘরে চেতন-অচেতনে
করছে আহাজারি
আমি জলমগ্ন, আমি নিমজ্জিত হচ্ছি ক্রমাগত l আমার নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে l আমি বাঁচতে চাই l বাঁচতে চাই l
এই সব মর্মান্তিক খবরগুলো জমা হবে ইতিহাসের কোষে
কাঁদে পরাভূত আশা, অণুজীব ফুঁসে ওঠে
অপেক্ষারা ক্লান্ত দিয়েছে উড়াল অনির্দিষ্টকালের পথে
বেদনারা বড় হতে থাকে জ্যামিতিক হারে
বন্দী থেকো ঘরে l দেখা হতেও পারে l
কেটে গেলে মহামারিকাল l বিদায় নিলে জীবাণুকাল l

স্বপ্ন কুমার

মৃত্যুই যখন কমন ভিজিটর আমাদের

(বন্ধুগণ, প্রিয় স্বজন আমার—
আসুন, আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের—যাঁরা আছেন সম্মুখ সমরে,
প্রার্থনা করি তাঁদের জন্য, যাঁদের দীর্ঘ যাত্রায় একদিন আমরাও হব শামিল)

আমি চাই তুমি আরও কিছুদিন থাকো
আরও একটু শিক্ষা হোক— আমাদের
জানি
আরও কিছু ফুল
আরও কিছু পাতা
নিশ্চিত ঝরবে অবেলায়—
নাহয় ঝরুক
তবুও চাই
তুমি আরও কিছুদিন থাকো
আমাদের অন্তত
আরও একটু বোধোদয় হোক
আমরা যেন আরও একটু মানবিক হই

ওজন স্তরের ফুটো গুলো ভরে যাওয়ার আগে
বিষাক্ত ভারী বাতাস হালকা হওয়ার আগে
নদী আর সাগরের জল কাকচক্ষু হওয়ার আগে
হলুদ পৃথিবীটা আরও একটু সবুজ-সবুজ
হওয়ার আগে
আমি চাই তুমি যেন আমাদের মাঝে থাকো
আরও কিছুদিন

আর
ধর্মের নামে
বর্ণের নামে
গোত্রের নামে
অণু-পরমাণুর নামে
যারা পেশি দেখায় নিয়ত
তারাও জানুক
আসলে কত ক্ষুদ্র—কত অসহায় তারা...