কাজ হারিয়ে বাড়ছে হাহাকার

বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর একটু দেরিতে হলেও সংক্রমণ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় নিউইয়র্কে। কিন্তু থামছে না আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃত্যুর মিছিল। শুধু দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কবর দেওয়ার জায়গা নেই, আবার মরদেহ পাওয়ার জন্যও দীর্ঘ অপেক্ষা। এরপর কবরের জায়গা পাওয়ার পর সেই কবরের সব কাগজপত্রের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাও আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা। এখন যারা বেঁচে আছেন, তাদের কাছে সবচেয়ে কষ্টের কাজটি হচ্ছে পরিবারের কেউ মারা গেলে তাঁর দাফন বা শেষকৃত্য!

আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল অঙ্গরাজ্য নিউইয়র্ক এখন এক মৃত্যুপুরি। নিউইয়র্ক নগরের বাতাসে এখন লাশের গন্ধ। মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না রাজ্যের গভর্নর ও সিটি মেয়র। একদিকে লাশের পর লাশ জমছে, অন্যদিকে কান্নার সঙ্গে হতাশার আকাশ ভারী হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ, ব্যস্ত নগরে আজ আক্রান্তের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে ৩ লাখের বেশি মানুষ। আর এই মহামারি ভাইরাসের কারণে নিউইয়র্ক নগরীতে কাজ হারিয়ে কর্মজীবী মানুষ আজ দিশেহারা।

নিউইয়র্কে দীর্ঘ ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সৈয়দ নাজিদা। করোনার কঠিন এই পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সঙ্গে।

নাজিদা বলেন, করোনা নিউইয়র্কে ছড়িয়ে পড়ার আগে বুঝিনি, এই অবস্থা আজ তৈরি হবে। কাজ নেই প্রায় দেড় মাস। আমি আর আমার ছোট মেয়ে থাকি। তাই দরকার এবং ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পারি না। বাচ্চার কথা চিন্তা করে ঘর থেকে বের হওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছি, তবে এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয়নি। প্রণোদনার চেক পেলাম, সেটা বাসা ভাড়ায় চলে গেল। আগামী দিনগুলো কীভাবে যাবে সেটি নিয়ে কুল পাই না!

শুধু নাজিদা নন, এ রকম কয়েক লাখ মানুষ আজ আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় নিউইয়র্কে দিন কাটাচ্ছেন।

নিউইয়র্কে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে ট্যাক্সিক্যাব চালান মজুমদার নামের আরেক বাংলাদেশি আমেরিকান। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো বাসা ভাড়া দিতে দেরি করিনি। কিন্তু আজ বাসা ভাড়া দেব বা গ্রোসারির জিনিসপত্র যে কিনব, সেই অর্থও নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমার আত্মীয়ের সাহায্য নিতে হচ্ছে।’

বাংলাদেশি আমেরিকান আহমেদ গ্যাস স্টেশনে ফুড ভেন্ডারে কাজ করেন। এক মাস আগে শরীর খারাপ হলেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হননি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি হাসপাতালে যাওয়ার পর ভাইরাস হয়, তাহলে যে কয়টা দিন বাঁচার আশা আছে, সেই আশাও আর থাকবে না।

আহমেদের আতঙ্ক যদি থাকে, তবে এই নগরে কঠিন সময়ে উল্টো চিত্রও আছে। একদিকে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর হাহাকার বাড়ছে। অন্যদিকে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন স্বদেশি ডা. ফেরদৌস, তরুণ কমিউনিটি নেতা জয় চৌধুরী, বাংলাদেশ সোসাইটির রহিম হাওলাদার, প্রিন্সিপাল মুফতি মুহম্মদ ইসমাইল, নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা ইফতেখার চৌধুরী, নার্স সারাহ হোসাইনের মতো অনেক বাংলাদেশি আমেরিকান।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ ঘরে গিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, কেউ খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন, কেউ নিজ ইচ্ছায় জানাজার নামাজ পড়াচ্ছেন, কেউ মাস্ক বিতরণ করছেন।

জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার যে লড়াই এখন চলছে, সেই যাত্রায় বেঁচে যাওয়াটা এখন আরেকটি চ্যালেঞ্জ—এমনটি মনে করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।