কৃষ্ণগহ্বরের পূর্ণাঙ্গ চিত্রের স্রষ্টা

তনিমা তাসনিম

এমন এক সময় ছিল, যখন ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না। ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজে মুসলিম নারীদের জন্য শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। আজ তারই দেখানো পথে বাংলার নারীরা জয় করছেন বিশ্বকে। তনিমা তাসনিম (অনন্যা) তাদেরই একজন। বিশ্বের বুকে সগৌরবে বাংলাদেশের পতাকা বহন করে চলছেন তিনি।

কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে বিজ্ঞানীদের জল্পনা–কল্পনার শেষ নেই। ব্ল্যাকহোল হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে আলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারে না। তনিমা তাসনিম ব্ল্যাকহোলের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ব্ল্যাকহোল থেকে আসা আলো বিচ্ছুরিত হতে না পারা এবং ব্ল্যাকহোলের আশপাশে গ্যাস ও ধোঁয়াশার ফলে কখনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনি হাল না ছেড়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকতে সক্ষম হন। পাশাপাশি মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় এরা বেড়ে উঠছে এবং পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে—তিনি সে সম্পর্কেও ধারণা দেন। তনিমা বর্তমান মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভারী কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ করছেন।

মহাবিশ্ব নিয়ে তনিমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকে। তাঁর এই আগ্রহ তৈরির পেছনে বাবা মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম ও মা শামীম আরা বেগমের অবদানই সবচেয়ে বেশি। গৃহিণী মায়ের বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও কোথাও বিজ্ঞান মেলা হলে কিংবা টিভিতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠান দেখলে সব সময় মেয়েকে উৎসাহ দিতেন। তনিমার মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মা যখন মহাকাশে অবতরণকারী পাথফাইণ্ডার যানের গল্প করেছিলেন, তখন থেকেই তাঁর মহাকাশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ জাগে। অলিম্পিক গেমসের সময় মা প্রতিদিন ভোরে গেমস দেখতে ডেকে তুলতেন। শুধু খেলা দেখাই নয়, অলিম্পিকের বিভিন্ন খেলা দেখে মেয়ে কি শিখছে না শিখছে নিয়মিত তার তদারকিও করতেন। মেয়ের মহাকাশ সম্পর্কে জানার এত আগ্রহ দেখে তাঁর মা মহাকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বই ও এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিতেন। ১৯৯৫-৯৬ সালের সূর্যগ্রহণ তনিমার মহাকাশ নিয়ে গবেষণার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে।

কথায় আছে, দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা ঠিকই পথের সন্ধান করে নেয়। তনিমাও এর ব্যতিক্রম নন। মহাকাশ নিয়ে গবেষণার অসীম আগ্রহের ফলে বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতিতে একা মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা, এ নিয়ে মা-বাবা বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহ ও প্রবল ইচ্ছার কাছে সবকিছু হার মানল। স্বপ্নের বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তাঁকে কখনো পেছনে ফেরে তাকাতে হয়নি।

টানা ছয় বছর ধরে সায়েন্স নিউজ নতুন ও ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি থাকা ১০ বিজ্ঞানীর গবেষণা ও তাদের উদীয়মান সম্ভাবনাকে পর্যালোচনা করে একটি তালিকা প্রকাশ করে। সম্প্রতি সেরা এই দশজনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন তনিমা তাসনিম। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার, মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তনিমা বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে, সব বাঁধাবিপত্তি টপকে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ও লেভেল পরীক্ষায় সারা দেশে পদার্থ, গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নম্বরসহ মোট সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাস করেন। বাংলাদেশে তখনো মহাকাশ নিয়ে গবেষণা বা এ নিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রে আসার সিদ্ধান্ত। পেনসিলভানিয়ায় ব্রিন মর কলেজে। সেখানে একই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান—দুটি বিষয়ে স্নাতক করেন। তখন বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে।

নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকলে যেকোনো কিছুই করা সম্ভব। তনিমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্নাতক পর্যায়ে পড়ার সময় ২০১১ ও ২০১২ সালে নাসা এবং সার্নে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগে মহাকাশ নিয়ে গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। নাসায় কাজের পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞান এডাম রেইসের সঙ্গে তাঁর অফিসে বসে কথা বলার সুযোগ হয়। আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিটার হিগসকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্যও হয়। এসব ঘটনা তাকে গবেষণায় মনোযোগ দিতে এবং ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তারপর ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি ডার্টমাউথ কলেজের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের পোস্ট ডক্টারল রিসার্চ সহযোগী।

দিনের পর দিন কোনো কিছু নিয়ে টানা চিন্তা ও গবেষণা করে গেছেন। কখনো আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশ হয়েছেন, কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি। সব সময় নিত্যনতুন চিন্তা দিয়ে কাজে মগ্ন থাকার ফলেই ব্ল্যাকহোলের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি আঁকতে সক্ষম হয়েছেন।

শিক্ষকতা তাঁর ভীষণ পছন্দ। ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছার কথা জানাতেও ভোলেননি তিনি। গবেষণা তার ধ্যান-জ্ঞান। কখনো গবেষণা বাদ দিতে চান না।

সম্প্রতি তিনি উই-স্টেম নামে একটি সংগঠন চালু করেছেন, যেখানে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেও মহাকাশ নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী তরুণদের জন্য বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবে।