ক্ষমতায়ন করুন নিজেকে

আমরা অনেক ধরনের ক্ষমতায়নের কথা জানি, শুনি। বিভিন্ন সময় সভা–অনুষ্ঠানে বিষয়গুলো উঠে আসে। তখন মনে হয়, কেবল আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানেই ক্ষমতায়ন জরুরি। অথচ মানসিকভাবে শক্তি না আসলে কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্ভব না। কোনো একটা অনুষ্ঠানে দেখা গেল, আলোচনায় নারীর ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে একে অপরের হাত থেকে কীভাবে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবেন, ভেতরে-ভেতরে চলে সে যুদ্ধ। নারী কেন রাজপথ থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট, অফিস, ব্যবসা সব জায়গায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনই চলছে। কে কারটা ছিনিয়ে নেবে ও নিচ্ছেন। কিন্তু ক্ষমতায়ন কেউ কাউকে আদতে করে না। নিজেকে নিজেই ক্ষমতায়ন করতে হয়। অন্যের সাহায্যে অনেক সময় দাঁড়ানো হয়তো যায়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না। আর দেখা যায় তখন নেমে আসে হতাশা।
কিন্তু এই হতাশা অনেক সময় জীবনও কেড়ে নেয়। অথচ নিজেকে ক্ষমতায়ন করার মতো শক্তি থাকলে হয়তো এমন পরিস্থিতিই জীবনে আসবে না, আসলেও মানসিক স্থিতি বা স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না।
আমরা শিখিনি কখনো, নিজেকে কীভাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে ঠিক রাখা যায়? আমরা শিখে আসছি, দোয়া চাও। দোয়া করো। অন্যকে দোয়া দাও। সব মা–বাবাই তো দোয়া দেন। তারপরও কখনো কখনো দোয়া কাজ করে না। তাঁরা যদি কখনো বলতেন, নিজেকে দোয়া দাও!
নিজেকে দোয়া দেওয়া যায়? এটা কখনোই শিখিনি। তবে যায়। এটাও এক ধরনের ক্ষমতায়ন। কঠিন বিপদের সময় যখন একজন মানুষ ভেঙে পড়বে। আত্মহত্যার জন্য পা বাড়াবে, কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়ার বা এমন চিন্তায় না যাওয়ার পথ কখনো কেউ বলে দেয় না। অথচ জানা থাকলে এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
জীবনের যেকোনো কঠিন সময়ে নিজেকে নিজে বলুন। কি বলবেন? চোখ বন্ধ করে বলতে হবে, ‘আমি ভালো আছি। আমি ভালো আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ যদি ঠিক নাও থাকে, তবু বলুন। দেখবেন, মন এই তথ্য গ্রহণ করছে। মন এক সময় এই তথ্য শরীরে, মাথায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। যে মাথা এলোমেলো ছিল, কয়েক মিনিটের মধ্যে তা আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য অন্য পথ দেখাচ্ছে। বলবে, চাকরি একটা গেলে আরেকটা পাব। পরীক্ষায় একবার ফেল করেছি, সমস্যা নেই আরেকবার পাস করব। প্রেমিক বা প্রেমিকা একটা গেলে আরেকটা পাব। অন্যরা কে কতক্ষণ পাহারা দেবে? দোয়া দেবে? সাহস দেবে? দিতে হবে নিজেকে নিজে।
কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে, চোখ বন্ধ করে ১০ মিনিট বলুন যে, আমি ভালো আছি, আমি সুস্থ আছি। আমার কোনো অসুখ নেই। গভীর বিশ্বাস নিয়ে বলুন, দেখবেন আপনি সুস্থ বোধ করছেন। আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর—তাঁরা তো শুনবেন প্রকৃতিও এক সময় পরিস্থিতি বদলে দেবে। নিজের বিশ্বাস অনেক বড় ক্ষমতা। ডাক্তার রোগী দেখেন, ওষুধ দেন এতে ৫০ ভাগ রোগ ভালো হয়। বাকি ৫০ ভাগ একজন রোগীর নিজের আত্মবিশ্বাসের কাছে, নিজেকে ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে। এ জিনিসগুলো এখন বিজ্ঞান সম্মতভাবে কগনেটিভ সাইকোলজির গবেষণায় ওঠে এসেছে। একজন রোগী যখন তথ্য গ্রহণ করে, না আমি তো আর বাঁচব না। ঠিক হব না— তখন যত বড় ডাক্তার, বড় হাসপাতাল দেন না কেন, সে আসলেই সেরে উঠতে পারে না। প্রায় সময় দেখবেন, কেউ হয়তো ক্যানসারের রোগী, তাকে বা তাঁর আত্মীয়স্বজনকে অন্য কেউ এসে বলছে, পাঁচ বছর পর আবার হয়ে যায়। তখন যদি এ ভয় কাজ করে হবে। কিন্তু এ ধরনের তথ্য কখনোই গ্রহণ করবেন না। বরং বলতে থাকুন, ‘আমি বা সে সম্পূর্ণ সুস্থ, আমার কোনো রোগ নেই।’
ক্ষমতায়ন জিনিসটার সঙ্গে আমরা খুব ছোট বেলায় পরিচিত হই। শিশু বয়সে হাঁটিহাঁটি পা পা করে হাঁটার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না পড়ে যাই। দেখা গেল, মা–বাবা দৌড়ে এসে আঙুলে ধরে তোলেন বা দাঁড় করালেন। তারপর আঙুল ধরে ক্ষমতায় নির্দেশ করার চেষ্টা করেন। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাঁরা সাহায্য করেন। আমরা শরীরের মেরুদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে মনটাকেও অন্যের দ্বারা শাণিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকি। কখনো নিজেকে ক্ষমতা দেব, ভাবতেই পারি না। যারা ভাবেন তাঁদের সংখ্যা খুব কম।
অনেক আছে যারা ভাবে তাঁদের ক্যারিয়ারটা পর্যন্ত মা–বাবা গড়ে দেবেন। আজকের পৃথিবীতে বলা যায়, সব মানুষ খুব বেশি একা। এখন আর আগের মতো সবাই এক রুমে বসে এক টিভি দেখে না। সবার রুমে রুমে টিভি। হয়তো দল বেঁধে একটা পারিবারিক ছবি বা আচার–অনুষ্ঠানে সবাইকে এক সঙ্গে দেখা যায়। কিন্তু নিজের ঘরে সবাই যেন অনেক অচেনা। যার যার রুমে, যে যার মতো ব্যস্ত সামাজিক মাধ্যমে বা পছন্দের টিভি চ্যানেলে। যখন একাকিত্ব ভর করে, তখন ওঠে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে যায়। যে ছেলেমেয়ে মায়ের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে বলে, ‘লিভ মি অ্যালোন’—সে আর একটা সময় মানসিক চাপে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। যখন মা–বাবার জন্য হাত বাড়ায়, তখন সময় নেই।
অনেকেই বলেন, অলৌকিক ঘটনা বলে কিছু নেই। কিন্তু এই অলৌকিক ঘটনা আমরাই তৈরি করি বা করতে পারি। এটা আমার কথা নয়, আধ্যাত্মবাদের কথা। তাঁরা বলেন, তুমি শুধু চিন্তা চেতনায় তোমার স্বপ্নের একটা স্পষ্ট রূপ দাও। বিশ্বাস স্থাপন করো। এটা বাস্তবে ওঠে আসবে। যাকে ইংরেজিতে বলে, Energy transforms, Dream manifest, এটাও এক ধরনের নিজের ক্ষমতায়ন। আমি অবশ্য এ কথাগুলো খুব বিশ্বাস করি। অনেক সময় স্পষ্ট না হোক, অনেক অস্পষ্ট চিন্তাও বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বাস না হলে নিজে চোখ বন্ধ করে হিসাব করে দেখুন, আপনার নিজের জীবনে যা যা ঘটেছে, তারা মধ্যে আপনার নিজস্ব চিন্তা–চেতনায় সবকিছু আছে। জীবনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, অঘটন ঘটে। এখানেও আমাদের ভয়ের প্রভাব পড়ে। এগুলোও কাটানো যায় বা নিজেকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে এ থেকে বের হওয়া যায়।
এবার একটা ছোট গল্প দিয়ে শেষ করি—একবার একটা মেয়ে আত্মহত্যার জন্য উঁচু ভবনের চত্বরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তাঁর মনে কী ভাবনা এল যে, সে কাছে মেডিটেশন সেন্টারে সিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে গেল। তাঁর প্রশ্ন, আমি তো খুব নিষ্পাপ ধরনের মেয়ে। ঈশ্বর আমার সঙ্গে এমন করলেন কেন? তাঁর সমস্যা হলো, তাঁর বিয়ের বছর খানিকের মধ্যে তাঁর স্বামী অফিসের অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন তাঁর মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সে বাবার বাড়ি ফেরত যেতে পারবে না। সে নিজে চাকরিও করে না।
সিস্টার তখন তাঁকে শিখিয়ে দিলেন, তুমি এখন মরতে যেয়ো না বা এসব চিন্তাও মাথায় এনো না। তুমি প্রতিদিন ভোরে তোমার প্রার্থনা শেষে নিজেকে শুধু বলো, ‘আমি এই লোকটাকে ভালোবাসি, আমি এই লোকটাকে শ্রদ্ধা করি।’ সে বলে, এটা কীভাবে সম্ভব, সে স্পষ্ট বলছে ওই মেয়ে ছাড়া তার চলবে না। আমাদের মাঝে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই। সিস্টার তাঁকে বলে দিলেন, আমি জানি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কিছু নেই। শুরুতে তুমি এটা বলো আর সে তোমাকে যত গালি দিক না কেন, তুমি বলো ঠিক আছে।
কিন্তু তাদের মাঝে কিছু তো ঠিক নেই। বঞ্চনা, ঘৃণা যত রকম মানসিক কষ্ট—সব আছে। তবে সে এটি প্রতিদিন বলত। স্বামী মনেপ্রাণে চাইত, সে যেন চলে যায়। এত খারাপ ব্যবহার করত যে, বলার মতো না। এরপরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, এ জন্য সে আরও রেগে যেত এবং বলত, কী ঠিক আছে? এভাবে প্রায় ছয় মাস গেল এবং একটা সময় সে লক্ষ্য করল, এত খারাপ আচরণ করার পরও লোকটির জন্য তার মায়া হয়। স্ত্রী হিসেবে সে তার সব দায়িত্ব পালন করত। সে ভালোবাসতে শুরু করল।
এমন অবস্থায় স্বামী মেয়েটিকে এই ফ্ল্যাটে একা ফেলে ওই মেয়েকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল। তখন মেয়েটি সিস্টারের কাছে গেল। সব বলল। সিস্টার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এখনো আত্মহত্যা করতে চাও? সে বলল, ‘না, আমি আমাকে গুছিয়ে নিয়েছি।’ পরিস্থিতি পরিস্থিতির জায়গায় আছে। শুধু বদলে গেছে একজন মানুষের মনের ধারা। এটাই ক্ষমতায়ন। শুরুতে নিজেকে মিথ্যে করে বলতে হয়, ‘আমি ভালো আছি’। এক সময় ভালো থাকতে আমি বাধ্য। সে এরপরও তাঁর জপ বন্ধ করেনি। ছয় মাস পরে সেই লোক ফোন করেছে, আমি আমার সংসারে ফেরত আসতে চাই। সে বলেছে, ‘আসো।’ তারপর দশ বছর কেটে গেছে তাঁদের দুটি ছেলেমেয়ে। সুখে আছে যাকে বলে ‘Happily ever after’।
এটি ভারতের একটা সত্য ঘটনা। অলৌকিকের মতো যদিও সব সময় জীবন এ রকম হয় না। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতেও বেঁচে ওঠা যায়। এ রকম ক্ষেত্রে অনেক আত্মীয়স্বজন এসে বলবেন, এই লোককে কখনোই বিশ্বাস করো না, সে আবার যাবে না যে গ্যারান্টি কি? কিন্তু যে জানে সে নিজে ক্ষমতাবান, তাঁর গ্যারান্টি সে নিজেই। এ রকম ঘটনা এখন খুব সাধারণ ব্যাপার। চাইলে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কেউ ফিরে না আসুক, কিন্তু ভাঙা অবস্থায় ঠিক থাকতে পারা অনেক বড় ব্যাপার। নিজেকে ক্ষমতায়ন করতে পারলে উপলব্ধি করা যায় সুখ–দুঃখ–ঘৃণা সব নিজের মধ্যে। কারও চলে যাওয়াতে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। মেয়েটি ওই পরিস্থিতিতে তাঁর স্বামীকে ঘৃণা করলেই পারত। কিন্তু সে শুধু দুটি বাক্য দিয়ে নিজেকে বদলেছে। অনেকে ঘৃণা নিয়েও বসবাস করেন এক সঙ্গে। যার প্রভাব পড়ে বাচ্চাদের ওপর। নিজেকে ক্ষমতায়ন করে দেখতে পারেন। ভালোবাসায় বসত গড়তে পারেন।
ইয়োগিক বিজ্ঞান নিয়ে সাধ গুরু সারা বিশ্বের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাতিয়ে রেখেছেন। ওনার এক বক্তব্যে উনি বলেছেন, ‘ধরুন কালকে আপনি আপনার সব টাকা–পয়সা হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন এবং ঠিক করলেন, আত্মহত্যা করবেন। তখন একবার মুখ ভালো মতো বন্ধ করে নাক হাত দিয়ে দুই মিনিট চেপে ধরুন। আপনার শরীর বলবে, রাখ তোর টাকা, আমি বাঁচতে চাই।
শুধু ব্যক্তি জীবন নয়। জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিই নিজেকে ক্ষমতায়ন করা যায়। যার প্রয়োজনীয়তা সব জায়গায়। মানুষ বেশি চাপে থাকে কর্ম ক্ষেত্রে। তাই নিজের স্বপ্ন চাহিদা এ জিনিসগুলো যদি জীবনের অগ্রভাগে ভাবা যায়, তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। নিজেকে গড়ার মধ্যেই অনেক কিছু গড়ে ওঠে। এখানে আমি যে জ্ঞান ব্যবহার করেছি, তাঁর বেশির ভাগই মেডিটেশন, আধ্যাত্মিক জ্ঞান।