গানের চেয়েও মধুর কথা

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আড্ডায় সবার সঙ্গে ফারিন দৌলা

গান কি সবাই গাইতে পারে?

—হ্যাঁ, পারে।

—কী বলছেন? কখনো শুনিনি এমন কথা!

—আমিও শুনিনি। প্রথম শুনলাম দুই বছর আগে নিউইয়র্ক উদীচীর এক সেমিনারে। বলেছেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ আবদুল মুত্তালিব বিশ্বাস। তাঁর কথা ও গান দুটোই সুন্দর। যেকোনো একটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে আমি প্রস্তুত।

সেদিন উদীচীর ওই অনুষ্ঠানে কথার ফাঁকে ফাঁকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পুরোনো দিনের গান শোনাচ্ছিলেন। তৃপ্তিতে মনটা ভরে গেল। বক্তৃতার একপর্যায়ে মুত্তালিব বিশ্বাস ‘না জানা’ সে কথাটি শোনালেন—‘যদি আপনি কথা বলতে পারেন, তাহলে গানও গাইতে পারেন।’

সেই মুহূর্তে ইভা রহমানের নাম মনে পড়ল। কেন, তা জানি না। বহু বছর আগে ডালাসে ফোবানার সংগীত সন্ধ্যায় শিল্পী ইভা রহমান মঞ্চে ওঠার আগে তাঁর সহকারীকে বারবার ব্রিফিং করছিলেন যন্ত্রীদলকে বলার জন্য, তাঁর স্কেলের যেন কোনো হেরফের না হয়। অন্যথায় গান ভন্ডুল হবে। কণ্ঠ ও যন্ত্রের যোগসূত্র তাহলে মানতেই হবে।

মুত্তালিব বিশ্বাসের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তা নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে উদ্যোগী হলাম। সমস্যা হলো গলাটা ছাড়ব কোথায়? লোক হাসাব নাকি! এর চেয়ে ভালো বাথরুম। গলা আর ছাড়া হয়নি, তবে গুনগুনানি কে ঠেকাবে?

তরুণ বয়সে দুই-চার জায়গায় গলা ছেড়ে বুঝেছি, বক্তৃতা আমার দ্বারা হবে। কিন্তু সেটাও স্থায়ী হলো না। রাজনীতিতে নাম লেখাইনি। এখন বছরে দুই-একবার ডাক এলে ঘেমে উঠি। দীপার ভাষায় বক্তৃতার পরপরই মনে হয়, ইস রে, ওই পয়েন্টগুলো মিস করলাম।

সম্প্রতি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আড্ডায় ফারিন দৌলাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তিনি গান জানেন কিনা। না জানলেও কিচ্ছু যায় আসে না। তিনি যে কথা জানেন তা গানের চেয়ে অনেক বেশি মধুর ও হৃদয়গ্রাহী।

গানের চেয়ে মধুর যাদের কথা তাঁদের মধ্যে আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তাঁর কথা শোনা যায়। মরহুম সৈয়দ আলী আহসানের কথাও শুনতে ভালো লাগত। নিউইয়র্কে যতক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছিলাম ৯৫ ভাগ সময় তাঁর কথাই শুনেছি। এবিসি নিউজের পরলোকগত পিটার জেনিংসের কথা শুনতেও ভালো লাগত। পিটার জেনিংস যখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার ওয়ার্ল্ড নিউজ পড়তেন, তখন আলাদা আকর্ষণ থাকত।

আমাদের মহান নেতাদের ভাষণ ছিল সংগীতের চেয়ে শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা হয় না। এর প্রতিটি শব্দের সঙ্গে রয়েছে প্রাণের স্পর্শ। মাওলানা ভাসানীর বক্তব্যে যে ছন্দের সৃষ্টি হতো তা সংগীতের সুরের চেয়ে শ্রুতিমধুর। মার্টিন লুথার কিং যখন বলতেন ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ তখন তা সুরের মূর্ছনায় ছড়িয়ে যেত সবার হৃদয়ে।

বৃহস্পতিবার আবার শুরু হবে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আড্ডা। দেড় বছর পর এই প্রথম। এ দিন আরও শোনা যাবে ফারিন দৌলার কথা। ফারিন বিলেতের ব্রিস্টলে থাকতেন। সেখান থেকে ইংরেজিতে ডিগ্রি ও ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছেন। ঢাকায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা এবং ‘ওয়ান সার্কেল’ সংগঠনের মাধ্যমে শিশুদের মানবিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। শিশুতোষ বইও লিখেছেন ‘তারা ও জয়’, দুই ভাষায় বাংলা ও ইংরেজি।

শেলী জামান খানের এক লেখায় পড়লাম, ফারিন দৌলা মনে করেন, শিশুর সামাজিকীকরণ ও মানবিকতা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ‘স্পর্শ’। কিন্তু কখনো কখনো এই ‘স্পর্শজনিত’ অভিজ্ঞতাই শিশুর জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। কথাটা মন ছুঁয়ে গেল। কথাটা এমন করে আগে কখনো শুনিনি।

এই আড্ডা সাধারণত অনানুষ্ঠানিক হয়ে থাকলেও সেদিন ফারিনের জন্য কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা পেল। ফারিনের বক্তব্য সবাইকে এতটাই তন্ময় করে রাখল, কয়েক মুহূর্ত নীরবেই কাটল। ফারিন যে বিষয়ে কাজ করেন, বাংলাদেশে সে বিষয়ে অনেকে প্রকাশ্যে কথা বলতেও আগ্রহী থাকেন কম। অলিখিত এক সামাজিক লজ্জাবোধ কাজ করে। দেখা যায়, এসব বিষয় এড়িয়ে চলা অথবা চাপা দেওয়ার প্রবণতা বেশি। এতে শিশুর ক্ষতি হয়। শিশু নির্যাতন, সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, যৌন হয়রানির বিষয় নিয়ে কাজ করেন ফারিন। এ ছাড়া শিশুর বিষণ্নতা যা তাকে কখনো কখনো আত্মহননের পথে নিয়ে যায়, তা নিয়েও কাজ করেন।

আড্ডায় ইব্রাহীম চৌধুরী ও জাহিদা আলম নিউইয়র্কে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজনের জন্য ফারিনকে অনুরোধ করেন। সায় দেন মাহবুবুর রহমান, ইশতিয়াক রূপু, সাব্রি সাবেরিন, শেলী জামান খান, আবদুস শহীদ, নাসিমা ফ্লোরা, মোহাম্মদ মনজুরুল হক, রোকেয়া দীপা, জাকির হোসেইন, মরিয়ম মারিয়া, সৈয়দ মাসুদুল কবীর, নুরুল হক প্রমুখ। ফারিন সানন্দে তাতে সাড়া দেন। এ রকম একটি ওয়ার্কশপ দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখাটি এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু একটি আত্ম আবিষ্কারের কথা না জানালে স্বস্তি পাব না। কথা বলি বেশি। পারিবারিক দুই-একটি অনুষ্ঠানে স্ত্রী-কন্যার হুঁশিয়ারি আমলে না নিলেও পরে কয়েকটি ফোনালাপে নিজেই অসুখটি ধরতে পারলাম। সত্যি, অ্যালার্মিং। এটা কি বয়সের সমস্যা? বয়ঃবৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে কথাও বেড়ে যায়, ফুরায় না। এক সময় কথা বলেন বেশি এমন বয়স্কদের এড়িয়ে চলতাম। কখনো যদি কোথাও আটকে যেতাম, ঘণ্টা দেড়েক তাঁর জীবন কাহিনি হজমের পর প্রাকৃতিক অজুহাতে রেহাই পেতাম।

কেউ কেউ বলেন, নিঃসঙ্গতা এর প্রধান কারণ। এখানে এ সময় আপনাকে কে দেবে? বাংলাদেশে চায়ের দোকানে বা গাছতলার ছায়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা এ নিঃসঙ্গতাকে কাটিয়ে দিত? কিন্তু এখানে? আড্ডার মানুষ পাওয়া যাবে, ঘণ্টাপ্রতি খরচ হবে ১০০ ডলার। যাকে বলে কাউন্সেলিং।

কয়েক সপ্তাহ আগে সিলেটের প্রগতিশীল রাজনীতিক লোকমান আহমদের সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো। এত কথা জমা হয়েছিল, শেষ হতে চায় না। লোকমান আহমদের সংকেতও বুঝতে পারিনি। আমার মধ্যে অতৃপ্তি রয়েই গেল। পাঁচ-ছয় মিনিটের আলাপে কি সাধ মেটে? পরে দেখলাম, আমরা কথা বলেছি ৫০ মিনিট।

সাংবাদিক ইব্রাহীম চৌধুরীর কৌশলটি খুবই কার্যকর—‘আমার আরেকটি ফোন এসেছে’। আর কারও সাধ্য নেই কথা বাড়ানোর। আমি শুকরিয়া জানাই, নিজের অসুখটি ধরতে পেরেছি। লেখার আকার নিয়ে যেভাবে যত্নবান, কথাতেই সে রকম থাকব।