ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে

বাংলা সাহিত্যের আঠারো শতকের শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়ের একটি পঙ্ক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করলে কেমন হয়? ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। মা-বাবা সব সময় তাঁদের সন্তানের জন্য এই মঙ্গল কামনাটিই করে থাকেন। সর্ব অর্থেই সন্তানের জন্য মা-বাবা দুজনই যেন নিবেদিত দুটো প্রাণ।
তবে আমি একজন বাবা। ‘বাবা’ শব্দটা আমার কর্ণকুহরে যখন প্রবেশ করে, তখন মনের অজান্তেই চোখের সামনে আমি আমার বাবার ছবিটা আবিষ্কার করি। সেই বাবার চেহারাটায় তখন দেখতে পাই কালো চশমার আড়ালে কঠিন আবার মায়াময় একজোড়া চোখ, সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে কি না, সেই নিয়ে তাঁর কতই না রাজ্যের উৎকণ্ঠা, সন্তানের মঙ্গল কামনায় যিনি সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত এক পুরুষ। আমাদের সে যুগের ‘বাবা’রা মোটামুটি সবাই কমবেশি ঠিক এমনটাই ছিলেন। ‘বাবা’ মানেই যেন আদর্শবান এক মহান পুরুষ। ছেলেবেলায় মনে হতো বাবা কখনো কোনো ভুল করতে পারেন না। তাঁর ভুল করা মানায় না।
বাবা হিসেবে আমার দায়দায়িত্ব কী? আমিও ঠিক অন্য আরও দশজন বাবার মতোই নিউইয়র্কের কঠিন ব্যস্ত সময়েও আমার সন্তানের সঙ্গে মূল্যবান সময়টাকে বাঁধতে চেষ্টা করি। আমার দুটো সন্তান। চার মাস বয়সী কন্যা চারুলতা এবং পৌনে দুই বছর বয়সী পুত্র সুফি। তাদের সঙ্গেই আমার প্রতিদিন হাজার রকম গল্পের লেনদেন হয়। আমার পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে দিনের বেলায় আমার খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। ক্ষুন্নিবৃত্তির কারণে সেই সাতসকালে আমাকে ঘর থেকে বের হতে হয়, কিন্তু বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যখন ঘরে ফিরি, তখনই তাদের সঙ্গে আমার জীবনের আরেক পর্ব শুরু হতে থাকে। শুধু সন্তানের প্রতি কোনো ভালোবাসা বা দায়িত্ববোধ থেকে নয়, আমি আমার সন্তানদের প্রতিদিন নিয়ম করে সময় দিই আমার একান্ত ভালো লাগা থেকেই। ওদের সঙ্গ আমি ভালোবাসি। আর বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি দায়িত্বের কথা যদি আসে, তাহলে বলব, শুধু পুত্র-কন্যার দিকে তাকিয়ে নয়, বরং স্ত্রীর দিকে তাকিয়েও একজন বাবাকে সব সময় তাঁর সন্তানদের সময় দেওয়া উচিত।
আমাদের বাঙালি সমাজে একজন মা সারাক্ষণ তাঁর সন্তান নিয়ে বেশ ঝুটঝামেলায় থাকেন। তাঁরা ঘর-সংসার সামলান, গৃহস্থালির বেশির ভাগ কাজ তিনি নিজেই করেন। সে ক্ষেত্রে একজন বাবাকে অবশ্যই তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে হবে এবং এর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সংসারের কাজগুলোকে যথাসম্ভব ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং সন্তানকে যতটুকু সম্ভব সময় দেওয়া। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সুন্দর

একটা সখ্য থাকলে দেখা যায় সন্তানও ঠিক তার পিতামাতার মতো করে নিজেকে তৈরি করতে চায় এবং এভাবেই মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বলার অপেক্ষার রাখে না, বর্তমান এই কঠিন বিশ্বে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্ব থাকাটা খুব জরুরি।
আমার বাসার চারপাশেই শিশুদের জন্য রংবেরঙের পার্ক রয়েছে। বসন্ত আশার সঙ্গে সঙ্গেই এই পার্কগুলো ছোট ছোট শিশু-কিশোর আর তাদের সঙ্গে আসা অভিভাবকদের কলকাকলিতে ভরে ওঠে। আমি রোজ বিকেলে কাজ থেকে বাসায় আসার পরপরই মেয়ে চারুলতাকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে যাই। এ বছর পুত্র সুফি বেশ বড় হয়ে গেছে। আশা করি সে-ও এবার আমাদের আনন্দযজ্ঞে যোগ দিতে পারবে। সত্যি বলতে কি, পার্কের ঘোরাঘুরির পুরো বিষয়টা আমার মেয়ের জন্য বা ছেলের জন্য যেমন খুব আনন্দঘন একটি বিষয়, আমার জন্যও ঠিক লোভনীয় একটি মুহূর্ত।
শেষ কথা হলো, সময় পাল্টে গেছে। আমাদের বাবা-মায়েদের মতো সেই পুরোনো ধ্যানধারণার সময় আর এখন নেই। বর্তমান সময়ে লিঙ্গভেদে কাজের কোনো বৈষম্য নেই বললেই চলে। সন্তান লালন-পালন আর ঘর-সংসারের কাজ এখন শুধু মায়ের একার কোনো কাজ নয়। এই কাজটি স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আনন্দের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। একজন সন্তান লালন-পালন শুধু মায়ের কোনো দায়িত্ব নয়। সন্তান যখন তার মা-বাবার খুব সান্নিধ্যে আসে, তখন সে নিজেকে তৈরি করে তার মা-বাবার আদলেই। আর এ কাজটিকে সহজ করে দিতে বাবার ভূমিকাই থাকে সবচেয়ে বেশি। ভুলে গেলে চলবে না ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’।