চেনা শহরে অচেনা নীরবতা

করোনা–আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গেছে নিউজার্সির পথ।  ছবি: রয়টার্স
করোনা–আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গেছে নিউজার্সির পথ। ছবি: রয়টার্স

আমেরিকার নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের টিনটন ফলসে আমার বসবাস। কুমিল্লা শহরের পর এই শহরটি আমার কাছে প্রিয়। আমার ভালোবাসার দ্বিতীয় শহর বলা যায়। জীবনের দীর্ঘ সময় বসবাস করছি এই শহরে। বিভিন্ন দেশের মানুষের বসবাস এখানে। তবে আমেরিকান বেশি। এই শহরের রাস্তা, অলি-গলি সবকিছুর সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার। শহর বলতে আমরা বুঝি ইট–পাথরের বড় বড় দালান। নিউজার্সির সে রকম নয়, এখানে যেমন বড় বড় বিল্ডিং আছে, তেমনি আছে সবুজের সমারোহ। বিশেষ করে রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। চলতি পথে গাছের সবুজ পাতারা হাতছানি দিয়ে স্বাগত জানায়। দমকা বাতাস এলে নুয়ে পড়ে পাতাগুলো। মানুষের কোলাহলে মুখর এই শহর।
কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এখন শহরজুড়ে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা।

ট্রাফিক লাইটে আগের মতোই সবুজ, লাল, হলুদ বাতি জ্বলছে, নেই শুধু মানুষের চলাচল। রাস্তাগুলো ফাঁকা। হরিণ, কাঠবিড়ালি দৌড়াচ্ছে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। স্বাধীনতার সাধ গ্রহণ করছে বন্যপ্রাণীরা। নির্ভয়ে জীবনের ছন্দ দুলিয়ে খেলা করছে প্রাণীগুলো।

শুধু মানুষ এখন ঘর বন্দী।

দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, স্কুল, ভার্সিটি বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে মানুষের কাজকর্মও। ফলে এতটাই নীরব হয়ে গেছে শহর, যেন কোন মানুষ নেই। নীরব, একেবারে শান্ত দিঘির জলের মতন। আটলান্টিক সাগর পারে ভিড় নেই মানুষের। শূন্যতা বিরাজ করছে। ঢেউগুলো আছরে পরে নিজেই আবার ফিরে যায় সমুদ্রের গভীরে। এ এক অন্য রূপ সাগরের। মানুষেরা নিজেদের এক ধরনের জালের মধ্যে আটকে ফেলেছে। দেখতে পাচ্ছে সবকিছু, কিন্তু কিছু করতে পারছে না। কারও আনন্দে শামিল হবে, সে উপায় নেই। কারও দুঃখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, সে উপায়ও নেই।

মানুষ আছে, কোন উৎসব নেই, খাবার আছে, সে খাবারে তৃপ্তি নেই। প্রতিবেশী আছে, যোগাযোগ নেই, দেখা হয় না, কথা হয় ফোনে বা অনলাইনে। ঘরে থাকলেও কিছুটা দূরত্ব থাকে একজন থেকে আরেকজনের। এই অল্প দূরত্বকে যেন কয়েক মাইল মনে হয়।

>একটা ভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। আপনজন নিয়ে সবাই ঘরে আছে, কিন্তু স্বস্তিতে নেই। কোন এক অজানা ভয় সারাক্ষণ মনের মধ্যে কাটার মতন বিঁধে আছে। এই বুঝি কারও খবর এল ভাইরাসে আক্রান্ত, এই বুঝি কেউ মারা গেল কিংবা নিজে কখন না আবার আক্রান্ত হয় সেই ভয়।


একটা ভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। আপনজন নিয়ে সবাই ঘরে আছে, কিন্তু স্বস্তিতে নেই। কোন এক অজানা ভয় সারাক্ষণ মনের মধ্যে কাটার মতন বিঁধে আছে। এই বুঝি কারও খবর এল ভাইরাসে আক্রান্ত, এই বুঝি কেউ মারা গেল কিংবা নিজে কখন না আবার আক্রান্ত হয় সেই ভয়।
উপন্যাসের প্রতি পৃষ্ঠা জানার মতন এ শহর আমার জানা। এমন নীরবতা আগে কখনো দেখিনি।
আর দেখবই বা কি করে, এ রকম পরিস্থিতি তো আসেনি কখনো। মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে শহর। হয়তো কিছুদিন পর আবার জেগে উঠবে তার নিজস্ব নিয়মে। মানুষ এখন অনলাইনে থাকে বেশি। ইন্টারনেটেই যোগাযোগ। মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবন বুঝি পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট হয়ে গেছে।
হাঁচি কাশি দিলেই মানুষ ছুটছে হাসপাতালে। ডাক্তার, নার্স তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। অজানা এক আশঙ্কায় তারাও প্রহর গুনে। তারাও মানুষ, তারা মানুষের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসা দেয়, কিন্তু অনেক সময় তারা নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে ভাইরাসে। তখন তাদের রঙিন স্বপ্নগুলো ধূসর হতে থাকে। কারণ তারা জেনে যায়, সার্কাসের জোকারের মতন দড়ির ওপর দিয়ে চলছে, একটু পিছলে পড়লেই জীবন শেষ।
জীবনের পদযাত্রা এখন মেপে মেপে চলতে হয় এক্কাদোক্কা খেলার মতন। দাগের একটু বাইরে গেলেই যেন বিপদ গ্রাস করবে। অজানা ভয় মানুষ লালন করে মনের মধ্যে। একটা প্রবাদ আছে, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’—ঠিক সে রকম। ঘরের দরজা–জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ভোরের সূর্য, প্রাণ ভরে বাইরে গিয়ে নিশ্বাস নেবে সে উপায় নেই।
কে ঝুঁকি নিতে চায়? এত সুন্দর ভুবন থেকে কে চলে যেতে চায়? কেউ চায় না। কিন্তু মৃত্যু অবধারিত, তা জেনেও বাঁচার কী আকুতি আমাদের! আমরা বাঁচতে চাই। যার ফলে করোনা ভাইরাস থেকে কী করলে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারব, সে উপায় খুঁজে তার পথ ধরে চলেছি। ঘরে থাকা, নিজের মতন করে সাবধানে থাকা যতটুকু সম্ভব। আর এই ঘরবন্দী জীবনের ফলে শহরজুড়ে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা।