ছেলেদের বন্ধ্যত্ব এবং আমাদের নারীরা
‘প্ল্যানেট ফিফটি-ফিফটি বাই ২০৩০’—এই বছরের নারী দিবসের থিম। মোদ্দা কথা হচ্ছে জেনারেশন ইকুইটি। জনসংখ্যার হিসাবে বর্তমানে নারী-পুরুষ উভয়ের অনুপাত সমান। এ অবস্থায় নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে এসেছে জোরালোভাবে। চাকরির ক্ষেত্র থেকে শুরু করে মজুরি বৈষম্য এসবই দূর করতে হবে। কিন্তু কে করবে, কেন করবে বা কবে নাগাদ এর সমাধান হবে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ জন্য যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে অবশ্যই নিজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
সবকিছুতেই সমানাধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রতি বছর দুনিয়াজুড়ে নারী দিবসের নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। আমি আলাদা করে নারী দিবসের ঘোর বিরোধী। নারী দিবসের নামে এ আয়োজনকে অনেকটা নারীদের আলাদা করার চেষ্টা বলে আমার মনে হয়। এও এক ধরনের বৈষম্য বলে আমার মনে হয়। সে যা-ই হোক, আজকের লেখা ছেলেদের ফার্টিলিটি নিয়ে।
বন্ধ্যত্ব নিয়ে এই আধুনিক যুগেও নারীদের একাই শুনতে হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। পুরুষের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে গোপনে কথা বলতে শোনা যায়। কারণ, আজকের দুনিয়ায় পুরুষই শ্রেষ্ঠ। বাবারাই বীরপুরুষ, আর ভাইয়েরা সংসারের সেনাপতি। স্বামী? সে তো যৌবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বা মহাপুরুষ। বিধাতা পুরুষের শারীরিক শক্তি মেয়েদের চেয়ে বেশি দিয়ে তৈরি করেছেন। তার জন্যই আমরা তাদের সবকিছুতে শ্রেষ্ঠ মানি।
কিন্তু পুরুষের শারীরিক সক্ষমতা কি শুধুই শক্তি প্রয়োগেই নিবদ্ধ থাকবে? নাকি তাদের শারীরিক সক্ষমতা সন্তান জন্ম দেওয়ার বা না দেওয়ার জন্যও দায়ী হবে? পুরুষের শারীরিক সক্ষমতা থাকুক, আর না থাকুক যুগে যুগে আমরা মেয়েরাই তাদের মাথায় তুলে রেখেছি। আমি অনেক উচ্চশিক্ষিত নিঃসন্তান নারীকে জানি, যাদের কেউ একবারের জন্যও বলেন না যে, তাঁদের সন্তান না হওয়ার জন্য স্বামী দায়ী। বলেন না কারণ, এতে সংসারে অশান্তি হয়। আবার মেয়েদের মনে একটা মিথ্যা ধারণা থাকে যে, তার সঙ্গী সন্তান জন্ম দিতে পারে না জানলে লোকে তাঁর স্বামীর যৌন সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আবার তেমনটি হলেও নারীরা তা লুকাতে চায়। কারণ, আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের যৌনজীবন নিয়ে কথা বলা বারণ। নারীদের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে লুকোছাপা করতে বেশি দেখা যায়। প্রত্যেককেই দেখা যায় নিজের স্বামীকে বীরপুরুষ হিসেবে তুলে ধরতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যৌন সক্ষমতা অনেক বেশি হলেই যে পুরুষটির সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা থাকবে, তা সত্য নয়। অথচ এমন ভুল ধারণা থেকে মেয়েরা বের হয়ে আসতে পারছে না। তাহলে দোষটা কাকে দেব?
পুরুষও যে বন্ধ্যা হয়, তা মেনে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো পুরুষের মুখে শোনা গেল না, ‘আমার জন্যই আমাদের পরিবারে সন্তান জন্ম নেয়নি’ বলতে। কোনো পুরুষ স্বীকার করে না যে, তার মধ্যে জীবিত শুক্রাণুর অভাব রয়েছে। আর যৌন সক্ষমতার প্রশ্নে তো একেবারে চুপ। হাজারো ছাইপাঁশ খেয়েও সে শক্তিশালী সিমিন তৈরি করতে পারে না। এ অক্ষমতা নিয়ে মেয়েরাও বিরূপ মন্তব্য করে না। কারণ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র আমাদের জানিয়েছে যে, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার বিষয়টি ছেলেদের হাতে নেই; যেমনটা মেয়েদেরও। এটা এক ধরনের অসুস্থতা। বদ্ধ ঘরে বউয়ের পায়ে চুমু খেলে বা ঘাড়ের রোঁয়াক ফুলিয়ে টাকা আয়ের ফিরিস্তি তুলেও এর কোনো মীমাংসা নেই। নিরাময় পেতে হলে যেতে হবে হাসপাতালে, করতে হবে যথাযথ চিকিৎসা। কিন্তু বহু শিক্ষিত লোককে দেখেছি এই সহজ সত্যটি মানতে পারে না। এখনো স্ত্রীকেই জোর করে তার সঙ্গীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হয়। স্ত্রী জানেন, কিন্তু সমাজের কাছে বলেন না। দায় নেন নিজের ঘাড়ে। শ্বশুর-শাশুড়িকেও বলেন, না যে আপনাদের ছেলে বন্ধ্যা।
সন্তান ধারণের অক্ষমতাকে বন্ধ্যত্ব বলা হয়। নারী-পুরুষ উভয়েই সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে পারে। নারীদের বন্ধ্যত্বের কারণ নির্ণয় করা খুব জটিল। তবে এ সমস্যার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। সব ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অনেক দম্পতি কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পায়।
পৃথিবীজুড়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছে। অনেকেই মনে করেন, বন্ধ্যত্বের জন্য একমাত্র নারী সঙ্গীই দায়ী। বিশেষত বাংলাদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা, বাচ্চা না হওয়ার জন্য স্ত্রীই দায়ী। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধ্যত্বের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনায় নারী দায়ী, এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে পুরুষ দায়ী এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশের জন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের আলাদা করে সমস্যা থাকতে পারে, আবার দুজনের একসঙ্গেও সমস্যা থাকতে পারে।
বন্ধ্যত্ব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘ফার্টিলিটি এক্সপো’। ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এ এক্সপোতে দেশের শীর্ষস্থানীয় সব বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত থাকবেন এবং অংশগ্রহণকারীদের সব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ফার্টিলিটি এক্সপোর প্রধান সমন্বয়ক ডা. মো. ফজলে রাব্বী খান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্ধ্যত্ব বা ইনফার্টিলিটি সম্পর্কে বেশির ভাগ দম্পতির মধ্যে নানা ভুল ধারণা, লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। এটি কোনো অভিশাপ বা দুর্ভাগ্য নয়। বরং চিকিৎসাযোগ্য একটি সাময়িক শারীরিক অবস্থা। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন এ বিষয়ে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা। মূলত এ কারণেই সহজবোধ্য ও ব্যতিক্রমধর্মী উপায়ে বন্ধ্যত্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হচ্ছে ‘ফার্টিলিটি এক্সপো’।
কংগ্রেসিয়া’র আয়োজনে এবং ফার্টিলিটি ও স্টারিলিটি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ এক্সপো আয়োজিত হচ্ছে। এর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক টি এ চৌধুরী বলেন, ‘আয়োজনটি হবে সচেতনতা ও শিক্ষামূলক। এখানে বন্ধ্যত্ব সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা, ভুল ধারণাসহ এ সম্পর্কে সব অজানা বিষয় অংশগ্রহণকারী যে কেউ জানতে পারবেন দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার অতি সাম্প্রতিক ও এমনকি ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও জানতে পারবেন অংশগ্রহণকারীরা।’
আয়োজকেরা জানান, দিনব্যাপী এই আয়োজনে সন্তান প্রত্যাশী দম্পতিরা ফার্টিলিটি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত আইভিএফ সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা, প্রজনন ও উর্বরতা-সংক্রান্ত ওষুধ আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক সংস্থাসহ সব পক্ষকে পাবেন এক ছাদের নিচে।
এক্সপোতে আগত যে কেউ যেকোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন। তাদের যেকোনো প্রশ্ন করার সুযোগসহ বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার সর্বাধুনিক পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। ফার্টিলিটি এক্সপোতে অংশগ্রহণ করতে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনকারীরা যেকোনো সময় যেকোনো সেশনে অংশ নিতে পারবেন। আর যারা ফার্টিলিটি এক্সপোর নির্ধারিত ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ ‘ফার্টিলিটি এক্সপো’-তে নিবন্ধন করবেন, তাঁরা এক্সপোর পক্ষ থেকে নিয়মিত আপডেট পাবেন বলে জানান আয়োজকেরা।
সবাই বলে আমার যারা প্রবাসী, তারা সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকি; আর দিন শেষে বাংলাদেশের যে যার এলাকায় ঘুমাতে যাই। মনের ভেতরে হাডসনের এপার থেকে সুড়ঙ দিয়ে দেশকে লালন করি। এই বছরের নারী দিবসের প্রাক্কালে এই সংবাদ পেয়ে অনেক আনন্দ লাগছে। এই ফার্টিলিটি এক্সপোর আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। আমি আশাবাদী স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এই সেবা নেবেন এবং সংসারজীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করবেন। সুখী হোক সকল পরিবার।