তালগাছের ভূত!

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের ঘটনা। তখন ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। বন্ধুরা মিলে দিনরাত্রি সমান তালে খেলাধুলা ও ঘোরাঘুরি করছি এবং জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। তখন বার্ষিক পরীক্ষার পর টানা এক মাস এভাবেই আমরা কাটাতাম। কৈশোরের যে উন্মাদনা, সেটা সম্ভবত ক্লাস নাইন-টেনেই সবচেয়ে বেশি থাকে। সেই উন্মাদনা থেকেই জন্ম নেয় অনেক অদ্ভুত ও মজার সব ঘটনা। আমাদের ওই সময়ে মানুষের মুখে একটা প্রচলিত কথা ছিল, তালগাছে থাকে ভূত আর তেঁতুল গাছে পেতনি। এই প্রচলিত কথাটি পুঁজি করে আমরা একটি মজার কিংবা ভয়ংকর ভুতুড়ে ঘটনার জন্ম দিয়েছিলাম। তবে এই ঘটনার জন্ম দিতে গিয়ে নিজেরাই বিপদে পড়েছিলাম এবং দীর্ঘদিন ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত ছিলাম। যা হোক, আসছি সেই ঘটনায়।
আমাদের এলাকার মসজিদ থেকে একটু দূরে রাস্তার পাশে কবরস্থান। সেখানে ছিল পাশাপাশি তিনটি তালগাছ। ওই তিনটি গাছের মধ্যে একটি ছিল আধমরা। ছোটবেলা থেকেই ওই গাছে কখনো তাল ধরতে দেখিনি আবার গাছটি একবারে মরেও না। এলাকাবাসীর কাছে ওই গাছটি একটি দোষী তালগাছ হিসেবে পরিচিত। সবার মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, ওই গাছে নাকি ভূত থাকে। যদিও কারও মুখে বলতে শুনিনি, কেউ কোন দিন ওই তালগাছে ভূত দেখেছে। তবুও ভূতের ভয়ে রাতের বেলায় ওই রাস্তা দিয়ে যেতে কমবেশি সবাই ভয় পেত। তাই কবরস্থানের ওই রাস্তা এড়িয়ে প্রায় সবাই অন্য রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করত।
আমাদের ওই সময়টায় এখনকার মতো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ছিল না। তবে বিটিভিতে ছিল বাংলায় ডাবিং করা বেশ কিছু জনপ্রিয় ড্রামা সিরিয়াল। তার মধ্যে অন্যতম আরব্য রজনীর গল্প অবলম্বনে ‘আলিফ লায়লা’। পুরো সিরিয়ালজুড়ে ছিল জিন–ভূতের গল্প। ছোটবেলা থেকে জিন–ভূতের অনেক গল্প শুনে বড় হলেও ওই সিরিয়াল দেখে আমরা জিন ভূতের শারীরিক গঠন, কথা বলা-হাসির স্টাইল ও আচার–আচরণ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা লাভ করি। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের ছোট গল্প ‘জিনের বাদশা’ আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল। তাই কীভাবে জিন সেজে ভয় দেখাতে হবে, সেই ধারণাটা ওই গল্প থেকে কিছুটা হলেও পেয়ে যাই। একদিন কজন বন্ধু মিলে একটা দুষ্টু বুদ্ধি বের করি। মসজিদের মুয়াজ্জিন হুজুরকে ভূতের ভয় দেখিয়ে এলাকায় ভূতের আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের দুই বন্ধু বাবু ও সুমন ছিল বেশ দুষ্টু ও সাহসী প্রকৃতির। এলাকায় নারিকেল ও ফল চোর হিসেবে তাদের বেশ খ্যাতিও ছিল। ছোটবেলায় মক্তবে আরবি পড়তে গিয়ে দুজনেই প্রায় প্রতিদিন মুয়াজ্জিন হুজুরের কাছে বেদম মার খেত। হুজুর মসজিদের সঙ্গেই একটা রুমে থাকতেন। তবে তিনি খাওয়া–দাওয়া করতেন রুটিন মাফিক একেকদিন একেকজনের বাড়িতে গিয়ে। তিনি আবার ভূতের ভয় পেতেন না, তাই কবরস্থানের ওই রাস্তা দিয়ে রাতে চলাফেরা করতে তাঁর সমস্যা হতো না। একদিন অমাবস্যার শীতের রাতে বাবু ও সুমন সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে ওই দোষী তালগাছের আগায় উঠে বসে থাকে। আর আমরা কজন বন্ধু আরেকটু দূরে বসে চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখছিলাম।
রাত তখন প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। আশপাশে কেউ নেই, একদম সুনসান নীরবতা। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে কে যেন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে। কুয়াশার কারণে চেহারা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে পাঞ্জাবি পরা কেউ একজন আসছেন। তাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম, তিনিই মুয়াজ্জিন হুজুর। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাবু ও সুমনকে বার্তা পৌঁছাতে শিয়ালের মতো করে কয়েকবার হুক্কা-হুক্কা ডেকে উঠি। আমাদের বার্তা পেয়ে বাবু ও সুমন তাদের কেরামতি দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিল। বাবুর কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি-ই চিকন ও তীক্ষ্ণ ছিল। তাই বাবু স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও সেটা একটু অস্বাভাবিক লাগত।
যা হোক, যেই না ওই পথচারী তালগাছের একদম কাছাকাছি চলে আসে, তখনই বাবু তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত রকম বিকৃত করে হাসতে শুরু করে। ওর হাসিটা সত্যিই খুব ভয়ংকর ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। যেটা শুনে আমরা নিজেরাও কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। সুমন তখন তার কোমরে বাঁধা সাদা শাড়ি নিচের দিকে নামিয়ে দিল এবং সে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে লাগল। ওই পথচারী টর্চ লাইট তালগাছের দিকে তাক করে যে দৃশ্য দেখলেন, তাতেই তিনি এক চিত্কারে মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। তখন ঝটপট করে বাবু ও সুমন তালগাছ থেকে নিচে নেমে এক দৌড়ে আমাদের কাছে চলে আসে। আমাদের চোখে–মুখে তখন বিজয়ের আনন্দ কিন্তু হই হুল্লোড় করে সেটা সেলিব্রেট করতে পারছিলাম না। বাবু ও সুমন তো বেজায় খুশি, মুয়াজ্জিন হুজুরকে ভূতের ভয় দেখিয়ে আজ জব্দ করেছে।
আমরা সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেলাম। মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি, কাল থেকে এলাকায় ভূতের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যাবে। আসলে তাই হলো, কিন্তু ঘটনায় একটু নাটকীয় মোড় নিল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি বাবু ও সুমনের বাবাকে জিনে ধরেছে। এই কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কোথায় বলবে, মুয়াজ্জিন হুজুরকে তালগাছের ভূতে তাড়া করেছে। কিন্তু না, এখন কি সব উল্টোপাল্টা কথা শুনছি! সুমনদের বাসা আমাদের বাসার কাছেই ছিল। ওদের বাসায় গিয়ে সুমনের মুখে আমি যা যা শুনলাম, তাতে পুরোপুরি তাজ্জব বনে গেলাম। কথাগুলো বিশ্বাস করতে যেমন কষ্ট হচ্ছিল, তেমনি নিজের ভেতরেও আতঙ্কের ঝড় উঠেছিল।
ওই দিন রাতে ওই পথচারী আমাদের মুয়াজ্জিন হুজুর ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং সুমনের বাবা। তিনি শর্টকাটে এই রাস্তা দিয়ে সিগারেট কিনতে যাচ্ছিলেন বাজারের দিকে। তিনি তার বর্ণনায় বলেছিলেন, তালগাছের ওপরে বিশাল লম্বা সাদা শাড়ি পরা একটা পেতনি দেখেছেন। পেতনিটা তাঁকে দেখে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভয়ংকর ভাবে হাসছিল এবং ধীরে ধীরে তালগাছ বেয়ে নিচে নামছিল। এই দৃশ্য দেখেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। যখন ওনার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন দেখেন মসজিদের মুয়াজ্জিন হুজুর ওনার পাশে বসে আছেন। মুয়াজ্জিন হুজুর নিজেই তাঁকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ভয়ে আতঙ্কে ওনার শরীরে জ্বর এসে গেছে। নিজের বাবাকে ভূতের ভয় দেখানোর অনুশোচনায় সুমন যতটা না লজ্জিত ছিল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিল বাবুর ঘটনায়।
ওই দিকে বাবুকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে নাকি মধ্য রাত থেকেই বাসার ভেতরে পাগলামি শুরু করেছিল। কবরস্থানের তালগাছে ওপরে ওঠার জন্য একদম পাগল হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে ভেবেছিলাম, বাবু হয়তো অভিনয় করছে। কিন্তু না, সে সত্যি সত্যিই এসব করছে। আমাদের দেখেও কোন পরিবর্তন নেই। উল্টো গত রাতের মতো ভয়ংকর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে আমাদের অনেক হুমকি–ধামকি দিয়ে কথা বলছিল। তখন আর বুঝতে বাকি রইল না, ওই তালগাছের ভূত বাবুর ওপরেই চড়াও হয়েছে। অনেক তাবিজ-কবচ, ঝাড়-ফুঁক করে বাবু সেই যাত্রায় ওই তালগাছের ভূতের কবল থেকে উদ্ধার হয়। আমরাও আর কখনো ওই তালগাছের আশপাশ দিয়েও যাইনি।