তোর জন্য বেঁচে আছি

অনেক দিন আগের কথা। আমাদের বিয়ের ১৮ বছর পেরিয়েছে। একটা ছেলে নিয়ে আমাদের সাজানো সচ্ছল সুন্দর একটা সংসার। বিয়ের এক বছর পরই আমার ছেলের জন্ম। আমি, আমার স্বামী, আমার বাবা-মা সবাই সেদিন ভীষণ খুশি। আর খুশি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! প্রথম বাচ্চা! সবারই অনেক স্বপ্ন ওকে ঘিরে। পরিবারে নতুন অতিথি আসছে। কী যে একটা অনাবিল আনন্দ আমাদের সবার! প্রথম মাস থেকে শেষ অবধি শুধু আনন্দই ছিল সারা বাড়িতে। নতুন মানুষের আগমন যেন আলো ঝলমল করে দিয়েছিল আমার জীবনকে।
ও আমাদের প্রথম সন্তান! একটু একটু করে বড় হতে লাগল ছেলেটা। ওকে ঘিরে আমার স্বপ্নগুলো দেখতে শুরু করে দিলাম। মনে আছে, ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলতে পছন্দ করতাম। ছেলের জন্মের পর এত সুন্দর একটা বাচ্চা যে, ওকে দেখে সবাই বলত, পুতুলের মতো সুন্দর একটা বাচ্চা। আর আমিও ওকে নিয়ে রাত–দিন পুতুলের মতো করে যত্ন করতাম। খেলতাম। আদর করতাম।
ওর ছোট ছোট পা দিয়ে সারা বাড়ি যেন ঘুরে বেড়াত। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, আমার ছেলেটা এত মনোমুগ্ধকর হয়েছে কেন? মায়ের নজর লাগবে নাতো? ওর যখন ১৫ মাস, এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী ওকে ১৫ মাসে এমএমআর ভ্যাকসিন দিতে হয়েছিল। এরপর যখন ওর দুই বছর পাঁচ মাস বয়স, হঠাৎ আমার ছেলেটা যেন অন্য এক জগতের মানুষ হয়ে গেল। আর কথা বলত না, মুখে কোনো শব্দ করত না। আমাকে অনুকরণ করে হাততালি দিত না। আমার দিকে তাকাত না। মনে হতো, বোবা হয়ে গেছে। প্রথম বাচ্চা বলে বুঝতেও পারিনি, ও স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো নয়। একসময় যখন কথা বলত আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। প্রথম সন্তান বলে অভিজ্ঞতার অভাবে বুঝতেও পারিনি কেন ওর এই পরিবর্তন।
একদিন আমার এক পরিচিতজন বেড়াতে এসে ওকে দেখে বললেন, আপনার ছেলে যে কথা বলে না, সে বিষয়ে ডাক্তার কী বলেছে। আমি তখন বললাম, ডাক্তার বলেছেন ছেলেরা একটু দেরি করে কথা বলে। আমাকে তখন উনি বললেন, তুমি ৩১১ কল করে ওদের বল, তোমার ছেলে কথা বলে না, বল যে, ওর বয়স প্রায় তিন বছর। তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে কল করলাম। ওরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিল বাসায় আসবার। নির্ধারিত দিনে বাসায় এসে সবাই মিলে ওটি, পিটি, স্পিচ কাউন্সেলিং করে আমার ছেলেকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করল। আমাদের দুজনের সবকিছু যেন ওলট–পালট হয়ে গেল যখন শুনলাম আমার ছেলে পিডিডি অর্থাৎ আমার ছেলের ভাষা বোঝা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। আই কনটাক্ট করে কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে দেখতে ওর সমস্যা হয়। খেলনা নিয়ে কল্পনা করে খেলতে পারে না। পরিচিত পরিবেশের পরিবর্তনে সমস্যা হয়। অঙ্গ সঞ্চালনে পুনরাবৃত্তি করে। এক কথায় তাদের পিডিডি বলে।
সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার ছেলে যে কথাগুলো বলে, সেগুলো শিশু ব্যাবলিং করে, সব কথা ও শব্দ অর্থহীন! এত আশা, এত জল্পনাকল্পনা যাকে ঘিরে সেই বাচ্চাটা আমার সুস্থ বাচ্চা নয়! ভীষণ কান্না পেয়েছিল। এই প্রথম শুনলাম, জানলাম অটিজম কী। যখন জানলাম অটিজম মস্তিষ্কের স্নায়বিক সমস্যা, যা মস্তিষ্কের সাধারণ কর্ম ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। অনেক কষ্ট হলো! আমার ছেলে তাহলে কোনোদিনই আর স্বাভাবিক হতে পারবে না! নিজেকে তৈরি করতে চেষ্টা করলাম কীভাবে ওকে সাহায্য করতে পারি। আমার ছেলে যখন বড় হতে লাগল, আমি দেখলাম আমার ছেলে যেন সব সময় নিজের মধ্যে মগ্ন থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলত না বা কথার উত্তর দিত না। নিজের চাওয়া–পাওয়া নিয়ে শেয়ার করে না। কিছু দরকার হলে কাঁদে। আমি বুঝে নিলাম আমার ছেলের মধ্যে যে অটিজম আছে, তার জন্যই ওর কোনো সামাজিক আচার–আচরণ নেই। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে সামাজিক আচার–আচরণ, যোগাযোগ ও ব্যবস্থার প্রচুর সমস্যা থাকে।
আমার ছেলের ঘুম খুব কম ছিল। ওর জন্য কত দিন ঠিকভাবে ঘুমাইনি, তার কোনো হিসাব আমার কাছে নেই। ওর যখন রাগ হয়, আমাকে চিমটি কাটে। আমি মা হয়েও ওর মনের সব ভাষা যে বুঝতে পারি না! পার্কে নিয়ে গেলে ওখানেও সে জানে না, কীভাবে অন্যদের সঙ্গে খেলতে হয়। সব পরিবারের মা ও বাবা পার্কে বাচ্চাদের খলতে দিয়ে নিজেরা নিজেরা গল্প করে। কিন্তু আমি যে শুধু ওর পিছে দৌড়াই, কীভাবে অন্যদের সঙ্গে একটু খেলবে। অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি খেলা করবে। ও চায়, অন্যদের সঙ্গে খেলতে কিন্তু জানে না কীভাবে। ও বল দিয়ে খেলার সময়, বলকে ধরে খেলার বদলে ওর মনযোগ নিবিষ্ট করে ওটার ওপর। বারবার পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে, একই কাজ বারবার করে। ফলে কেউ ওর সঙ্গে খেলতে চায় না। ওর কারণে আমার খুব একটা কোথাও যাওয়া হয় না। তার কাছে তো নিজের বাসা আর অন্যের বাসার কোনো পার্থক্য নেই। সব সময়ই ওদের আচরণ থাকে কিছুটা অস্বাভাবিক। কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করা তাদের জন্য কঠিন। মাঝে মাঝে মলে নিয়ে গেলে কখনো খুব বিরক্ত করে আবার তার পছন্দের কিছু হাতে দিলে তা নিয়েই যেন রাজ্য খুঁজে পায়।
কখনো বলে না, মা...আমি এটা চাই, ওটা চাই। কোন বিশেষ দিনে দৌড়ে এসে বলে না, মা আমাকে তুমি আমার বিশেষ দিনে কী দেবে। মাঝে মাঝে রাগ হলে অনেক ভালো ভালো কাপড়-জামা ছিঁড়ে ফেলে। রাগ হয়, কষ্ট হয়, ‘তুই এমন কেন করিস বাবা।’ একটা অটিস্টিক বাচ্চাকে এমন করে সময় দিতে গিয়ে কখনো কখনো স্বামী–স্ত্রী সম্পর্কেও ভাটা পড়ে যায়। এক সময় অনেক দূরত্বও সৃষ্টি হয়ে যায়। যতই হোক ওতো আমার নিজেরই সন্তান। খুব কষ্ট হয়, যখন দেখি ওর কোনো বন্ধু নেই। কাউকে ফোন করে না, কাউকে আসতে বলে না। আমিই ওর একমাত্র বন্ধু। ওর সঙ্গে আমি অনেক সময় কাটাই। রাতে ঘুমানোর সময় ওর পাশে শুয়ে যখন কাঁদি, সে যেন চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও মনে হয় কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। আমি বুঝি। কিন্তু শব্দ করে ও যে বলতে পারে না!
আমি যদি কখনো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি আর কাঁদি, বাবা আমি যে তোকে অনেক ভালোবাসি। ও বলতে পারে না মা আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার মতো কেউ তো নেই আর আমার আপন এই ভুবনে। আমার প্রার্থনা তোর জন্য, যখন আমি থাকব না, তুই কি সেদিন আমায় খুঁজবি? এই পৃথিবীতে তুই যেন এমন করেই নিরাপদে থাকিস বাবা। আমি যেমন তোর সব বুঝি, তেমনিভাবে তোর নতুন পৃথিবী তোকে তেমন করে যেন বোঝে, তোকে ভালোবাসে। সেই স্বপ্ন নিয়েই আজও বেঁচে আছি। বাবা তুই যে আমার নাড়িছেঁড়া ধন তোকে আমি অনেক ভালোবাসি!!!