দি হাই লাইন

তুষারপাত কিছুক্ষণ আগে থেমে গেছে। সম্ভবত আজকে আর বরফ পড়ার সম্ভাবনা নেই। বড় ছেলে ফোনে কল দিয়ে বলল, ‘বাবা তোমাকে ম্যানহাটন ঘুরাতে নিয়ে যাব, রেডি থেকো।’ আমাকে ঘুরাতে নিয়ে যাবে! কোথায়?
দেখ, তুমি শুধু আমাদের মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, সেন্ট্রাল পার্ক, ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে ব্রান্ডের বড় বড় দোকান, রকফেলার সেন্টার, টাইম স্কয়ার, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গায় নিয়ে যেতে। কিন্তু হাইলাইন, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ মডার্ন হিস্ট্রি, The Cloister Center of Medieval Art এসব জায়গায় নিয়ে যাওনি। শুধু পিকনিক আর বাঙালি অনুষ্ঠানে যেতে। আমাদের বিরক্ত লাগত। বললাম, এটা তো আমাদের শিকড় (root)। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। তোমাদেরও ওদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। আমিতো তোমাদের নিয়ে নায়াগ্রা ফলস, ক্যাপিটল হিল, Smithsonian National Art and Space Museum, শিকাগোর Sears Tower এবং আরও অনেক দর্শনীয় স্থানে গেছি।
আমেরিকায় স্বপ্নের বাস্তবায়ন যাঁরা দেখেছে, বসন্তের দিনগুলো নিজের অজান্তেই কখন যে হারিয়ে ফেলেছে। নতুন প্রজন্ম তা কেন মাথায় আনবে। সপ্তাহান্তে ওদের মতো অবসর কল্পনার ব্যাপার ছিল। জানি না, এসব উপলব্ধিতে থাকবে কিনা।
বাসায় একা। ওর মা কয়েক সপ্তাহ হলো বাংলাদেশে। আমার একাকিত্ব গোছানোর জন্য এই পরিকল্পনা কিনা তাও বুঝিনি। ওভারকোট পরে প্রস্তুত হলাম। কোটটি যথেষ্ট পুরোনো, আমেরিকায় আসার পরপরই কিনেছিলাম। লন্ডন ফগ। তুষারঝড়ের জন্য দারুণ উপযোগী। নিমেষেই পানি ঝরে যায়। উষ্ণতায় শীত কাছে আসতে পারে না। এখনো আনকোরা। নতুন মনে হয়। মেসি ডিপার্টমেন্টের ক্লথিং স্টোর থেকে নেওয়া। মূল্যছাড়ে অর্ধেক দামে কিনেছি সে সময়। কোনো ভালো অনুষ্ঠানে যেতে হলে ক্লজেট থেকে বের করি অন্যথায় জেসিপেনি থেকে কেনা ওভারকোট দিয়েই শীতের সিজন চালিয়ে নিই।
১১টায় আসবে বলছে। সঠিক সময়ে নিচে এসে ডোরবেল টিপতে লাগল। বললাম ওপরে উঠো। না উঠবে না। দেরি হয়ে যাবে।
গাড়ি নেব না। বাসা থেকে তিন ব্লক দূরে সাবওয়ে। আমরা সাবওয়েতে (ট্রেন) গিয়ে উঠলাম। মনে পড়ছে, ছোটবেলায় ওদের নিয়ে স্কুল ছুটিতে যখন বের হতাম, বেশির ভাগ সময়ই ট্রেন জার্নি হতো। গাড়ি চালানো তখনো ভালো করে শিখিনি। গন্তব্যস্থল প্রায়ই কনি আইল্যান্ড অথবা ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানা। ট্রেনের শীতল কামরায় ঢুকেই ওরা মহা আনন্দে মেতে উঠত। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছোটাছুটি করত। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন ছিল। তবে সুবিধা যে, ট্রেনের কামরাগুলো ফাঁকা থাকত। কারণ, মাত্র একটা স্টেশন আগে ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় অথবা পরে শেষ হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে এসে কামরাগুলোতে তেমন যাত্রী থাকত না। আমারও যেন এখন ওদের ছোটবেলার মতো ফিলিংস হচ্ছিল। শুধু ছেলের ‘নেতৃত্ব’ মেনে নিতে হয়েছে।
তখনো বলেনি কোথায় যাবে। যেমন আমিও আগে সঠিক বলতে পারতাম না। দেখা গেল, বলেছি ওদের বড় আন্টির বাসায় যাব, কিন্তু মন পরিবর্তন করে চলে গেছি সেন্ট্রাল পার্কে। এই প্রথম উদ্দেশ্যহীনভাবে ছেলের সঙ্গে বের হয়েছি। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছি? ছেলের কাছ থেকেও কোনো উত্তর এল না। ম্যানহাটনের নিচে সে এক বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে সিস্টেম। একেবারে মাকড়সার জালের মতো। একবার ঢুকে গেলেই যেকোনো গন্তব্যে যাওয়া যায়। টাইম স্কয়ারে ট্রেন বদল করে A ট্রেনে ডাউন টাউনের ট্রেনে চেপে বসলাম। মনে হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যাব, কিন্তু ছেলের ইশারায় ফোর্টিন স্ট্রিটে নেমে পড়লাম। তিন-চার ব্লক হেঁটে ওয়াশিংটন স্ট্রিটে স্ট্যান্ডার্ড হোটেলের কাছে চলে আসি। অনেক দিন গাড়ি থেকে হোটেলটি লক্ষ্য করেছি। সাধারণভাবে আধুনিক নির্মাণ শৈলী ব্যবহার করে মাত্র দুইটা স্তম্ভের ওপর আকাশ ছোঁয়া হোটেলটি দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকদের ভিড় ও পার্টি লেগেই থাকে সারাক্ষণ। একসময় এখানে মিট ডিস্ট্রিক্ট থাকায় বিদঘুটে গন্ধের জন্য কেউ আসত না। এখন লেটেস্ট ফ্যাশন ব্রান্ডের দোকানগুলো জমজমাট ব্যবসা করছে।
হোটেলের পাশ দিয়ে স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলাম ওপরে। হাই লাইনের ইনট্রেন্স। কখনো আসা হয়নি আগে। আমেরিকায় আসার পরেই চেলসিতে টোয়েলভথ স্ট্রিট থেকে থার্টি ফার্স্ট স্ট্রিট পর্যন্ত টেনথ অ্যাভিনিউয়ের ওপর পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ ট্রেন লাইনটি চোখে পড়ত। শুনেছিলাম ওটাকে ভাঙা হবে, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে পড়ে নগর কর্তৃপক্ষ এই আইডিয়া বাদ দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে অত্যাধুনিক এলিভেটেড স্টেট পার্ক বানানো হয়েছে। আগেও এখানে অনেক লোকের সমাগম হতো। নিচে থেকে পরিত্যক্ত রেললাইন মনে হলেও এখন বিনোদনের অন্যতম স্থান। ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই, কোনো দিন ট্রেন লাইন ছিল। কত দিন পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেছি। ভুলেও ভাবিনি, এখানে দেখার মতো কিছু আছে। উল্টো পর্যটকদের খামখেয়ালিপনা দেখে অবাক হতাম এই ভেবে, এঁরা কি আর কোথায়ও যেতে পারে না?
ছেলের সঙ্গে অবশেষে আমাকেই এখানে আসতে হলো। যদিও ‘হাইলাইন’ নামটি আগে ভুলেও আকর্ষণ করেনি।
ভেতরে গিয়ে একেবারে অভিভূত। কখন যে আবার তুষারপাত আরম্ভ হয়েছে, খেয়াল করিনি। মনে হলো, ধবধবে সাদা গ্রামের কোনো মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলছি। দুপাশে ফুলের বাগান। ছোট ছোট গাছের পাতাহীন ডালগুলোতে বরফ জমে জ্যোৎস্না প্লাবিত মনোরম এক মায়াবী দৃশ্যের অবতারণা করেছে। মাঝে মাঝে সেলফোনে ছবি তুলছি। হাডসন নদীর ওপারে নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। ওপারে জার্সি সিটি হবোকন, ওয়েস্ট নিউইয়র্কসহ ছোট ছোট শহর নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওয়েস্ট নিউইয়র্ক থেকে হাডসনের এপারে তাকালে মনে হবে, নিউইয়র্ক যেন স্বপ্নের এক জাদুকরী শহর। একেবারে বেরাজোনা নেরো ব্রিজ পর্যন্ত দৃষ্টি সীমানায় চলে আসে।
বরফে আবৃত এই সন্ধ্যায়ও বেশ কয়েকটি যুগল প্রেমিক–প্রেমিকার উপস্থিতি দেখলাম। চমৎকার আবহাওয়ায় কী পরিমাণ প্রেমিকাদের হাইলাইনে আগমন ঘটে এতে কল্পনা করা যায়। বেশ ভালোই লাগছিল। সত্যিই, এত দিন নিউইয়র্ক নগরে থেকেও এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার মতো সময় বের করতে পারিনি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ৩০-৩২ স্ট্রিটে হাডসন ইয়ার্ডে নবনির্মিত অত্যাধুনিক আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোর কাছাকাছি চলে আসলাম। ভেবেছিলাম, ওখানে নেমে যাব কিন্তু গেট বন্ধ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে গেট বন্ধ করে দেয় অথবা আবহাওয়ার কারণেও বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা আবার ফিরে আসলাম ফোর্টিন স্ট্রিটে। কয়েক ঘণ্টার জন্য নিজের অবস্থানকে অস্বীকার করে এতক্ষণ স্বপ্নের মায়াবী কোনো জগতে বিচরণ করছিলাম।
হাই লাইন থেকে নেমে একটা আমেরিকান ফাস্ট ফুডে ঢুকলাম। খেতে ইচ্ছে করছিল না, তবুও ছেলে অর্ডার দিল। সেখান থেকে চেলসি মার্কেটে ঢুকে দেখি এলাহি কাণ্ড। একটা চাইনিজ দোকানে বিভিন্ন ধরনের সাজানো মসলার গুঁড়া দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এত প্রকারের মসলা গুঁড়া থাকতে পারে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত DUNKIRK ছবিটি একসঙ্গে দেখার জন্য ছেলে আমাকে আপটাউনে লিংকন সেন্টারের কাছাকাছি বিকন থিয়েটারে যেতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। বেশ ক্লান্ত লাগছে। বললাম, আজকে না, আগামীকাল যাব। সেদিনও তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে। বরফে আচ্ছাদিত এই শহরে প্রথমবারের মতো আমেরিকান জীবনধারার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েছিলাম। ম্যাটেনি শো শেষে ফিফটি সিক্স স্ট্রিট, সিক্স অ্যাভিনিউয়ে ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। রাতের ফ্লাইটে সে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে চলে যাবে। ছয়-সাত ঘণ্টার উড়োজাহাজ ভ্রমণ। মাইক্রোসফটের সদর দপ্তরে কাজ করে। অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে মাঝেমধ্যে কয়েক দিনের জন্য নিউইয়র্কে আসে।
এত দিন আমাদের অনুশীলন, ড্রাইভিংয়ে ব্লাইন্ড স্পট ডিটেক্ট করা জরুরি—এ ধারণা যে ভ্রান্ত, সেটি বুঝতে এই দুটি দিনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন ছিল!
সন্ধ্যায় ফিফটি সেভেন সাবওয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন গিয়ে সোজা N ট্রেনে চেপে বসলাম। ছেলে ম্যানহাটনেই রয়ে যায়। ব্যস্ততম নগরীর বাঁকে বাঁকে ব্লাইন্ড স্পট খুঁজতে বাকি দিনগুলো হয়তো এভাবেই চষে বেড়াতে হবে।