দূরশিক্ষণের প্রতিবন্ধকতা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে

‘ম্যাকউইডেন এডুকেশন’ ও ‘ফেইথ বাংলাদেশে’র যৌথ আয়োজনে গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হল বিশেষ ওয়েবিনার। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল মহামারির প্রেক্ষাপটে ই-লার্নিং বা অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ। অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। সঞ্চালনায় ছিলেন বদরুল হুদা ও ম্যাকউইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি আফতাব।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বদরুল হুদা মহামারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি ও প্রভাবের ওপর আলোকপাত করে বলেন, সবকিছুর পাশাপাশি বিশ্বের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নতুন করে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বা ভার্চুয়াল এডুকেশন সিস্টেম এবং বিশ্বজুড়ে এখন ডিজিটাল মাধ্যম বা অন্তর্জালের ব্যবহার বেড়ে গেছে কল্পনাতীত। তাই ই-লার্নিং বা অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় এই আন্তর্জাতিক ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর এই ব্যবস্থা কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা আলোচনার জন্যই এই ওয়েবিনার আয়োজন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ম্যাসন রদ্রিগেজ (এলিমেন্টারি), নাদিয়া (৭ম শ্রেণি), সারিয়া (নবম শ্রেণি), কামিলা (হাই স্কুল), ভিভিয়ান (১২ শ্রেণি) এই ওয়েবিনারে অংশ নেয়।

আলোচনার সূত্র ধরে বাংলাদেশের নবম শ্রেণির ছাত্রী সারিয়া বলেন, অনলাইন ক্লাস বেশ ভালোই চলছে, অনেক সুবিধা আছে। অনলাইন লার্নিংয়ের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ঘরে বসেই ক্লাস করার বিরাট সুবিধা, যাতায়াতের ঝামেলা নেই, ইচ্ছে মতো হোমওয়ার্ক বা অ্যাসাইনমেন্ট করা যাচ্ছে, অনলাইনে রিসোর্স পাওয়া যাচ্ছে। কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন—নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট স্পিড সবার জন্য ভালো নয়, অনেক সময় সমস্যা হয়। এই অনলাইন লার্নিংয়ে ছাত্র–শিক্ষক সবাই নতুন। নিজেদের শিখতে হচ্ছে এবং মানিয়ে নিতে হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খেলার সুযোগ নেই। আমি স্পোর্টস-এর সঙ্গে জড়িত, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলি। এ ছাড়া সুইমিং পুলেও যেতে পারছি না, আমি সাঁতার কাটতে ভালোবাসি। এ ছাড়া আরও এক্সট্রা কারিকুলাম অনেক তৎপরতা মিস করছি। শিক্ষকদের আরও সচেতন ও সহানুভূতিশীল হতে হবে ছাত্রদের প্রতি।

নিউ ইয়র্ক থেকে যুক্ত ক্যামিলা তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে উল্লেখ করেন, দূরশিক্ষণ ভালোই চলছে অনলাইন লার্নিং ব্যবস্থায়। ক্লাসমেটদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। বাসায় বসে কম্পিউটারে অনেক কিছু শিখতে পারছি, অনেক রিসোর্স এক্সপ্লোর করতে পারছি সহজে। প্রয়োজনে আমাদের বাবা-মা আমাকে সাহায্য বা গাইড করতে পারছে। বাসায় সারা দিন ক্লাস করাটা একটু ক্লান্তিকর। কিন্তু তার চেয়ে বেশি যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়, তা হলো অনেক বেশি পরিমাণ হোমওয়ার্ক। স্কুলে যেমন শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে, অনলাইন লার্নিং সুযোগ ততটা নেই। স্কুলের বন্ধুদের মিস করি, ক্লাসে বসে কথা বলা যায় না, স্কুলে যেমন সরাসরি কথা হয়, আলাপ হয়, সহভাগিতা করার সুযোগ থাকে, অনলাইন লার্নিং-এ সে সুযোগ নেই।

ক্যামিলা বলেন, বাসায় স্কুল করাটা সুবিধাজনক, কিন্তু কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয়। কখনো কখনো অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের সহযোগিতা করে না, তাদের ক্লাসের সময় ব্যাহত করেন। অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ভিডিও গেমস খেলে বা অন্য কিছু করে, যা ঠিক নয়।

দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী পেনসিলভানিয়ার ভিভিয়ান বলেন, অনলাইন ক্লাস ভালো লাগছে, কারণ ভোরবেলায় তাড়াতাড়ি উঠে প্রস্তুত হতে হয় না। অনলাইন ক্লাস করার পাশাপাশি কম্পিউটারে অনেক কিছু এক্সপ্লোর করা যায়, শেখা বা জানা যায়। বাসায় বাবা–মাও সাহায্য করতে পারে। স্কুলে যাওয়ার ঝামেলা নেই। ইন্টারনেট কানেকশন ভালো থাকায় অনলাইন ক্লাস করার কোনো সমস্যা নেই। তবে স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের মিস করছি। ওদের সঙ্গে দেখা হয় না। শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার বা প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, এটা একটি বিশেষ প্রতিবন্ধকতা। সারা দিন কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে ক্লাস করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়, একেক সময় একটু বিরক্ত বোধ করি। এ ছাড়া ঘরের ভেতরে দিনের পর দিন সারা দিন ধরে ক্লাস করাটা শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলছে, যা আমাদের জন্য ভালো নয়, হাঁপিয়ে উঠছি। স্কুলে ক্লাস করার পাশাপাশি নানা ধরনের অ্যাকটিভিটিস চলে। এখন সেসব নেই।

ভার্জিনিয়া থেকে যুক্ত নাদিয়া বলে, অনলাইনে সহজে ঘরে বসে কম্পিউটার ব্যবহার করে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। সহজেই অনেক কিছু শেখা যায়, করা যায়। শিক্ষকের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করা যায়। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় সবার সঙ্গে কমিউনিকেট করা যায়। হোমওয়ার্ক করাটা আমার মনে হয় বেশি সহজ। জুমে ব্রেকআউট রুম থাকায় দলীয় আলোচনার সুবিধা আছে মতবিনিময় করে সহভাগিতার সুবিধা আছে। তবে শিক্ষা পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে করে ক্লাসে ছাত্ররা বিরক্ত বোধ না করে বা মনোযোগ দিয়ে আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে। আর এই পরিস্থিতি কত দিন চলবে, ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার পদ্ধতি কি হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা হয়। এভাবে নতুন পদ্ধতিতে আমাদের সবকিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়ার একটা ব্যাপার রয়েছে।

ভার্জিনিয়া থেকে অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়া সর্বকনিষ্ঠ ছাত্র ছিল ম্যাসন রদ্রিগেজ। ছয় বছর বয়সী কিন্ডারগার্টেন ছাত্র। ম্যাসনও বলল, বাসা থেকে অনলাইন ক্লাস করতে তার ভালো লাগে, বাসায় সে স্কুল করতে পারে, খেলতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের সবার অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করার পর বদরুল হুদা বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দূর শিক্ষণ বা ই-লার্নিং নিয়ে আরও চিন্তা করতে হবে, এটাকে কীভাবে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে উন্নত করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এটি একটি সুযোগ, অন্তর্জাল বা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ছাড়া অনেক কিছুই অচল হয়ে যেত। বাসায় বসে দূর শিক্ষণের যে সব প্রতিবন্ধকতা ছাত্র-ছাত্রীরা উল্লেখ করেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের বিবেচনা করতে হবে এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরিশেষে আফতাব বলেন, আজকের ওয়েবিনারে যে সব আলোচনা ও সবার যে অভিজ্ঞতার কথা সহভাগিতা হলো, তা থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি। ভবিষ্যতেও এমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও আলোচনা করার প্রত্যাশা রয়েছে। যে সব চ্যালেঞ্জ এবং তার সমাধানে যে সব পরামর্শের কথা ছাত্র-ছাত্রীরা উল্লেখ করেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ হবে করতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে।