দেশের অর্থনীতি মজবুত করছেন প্রবাসীরাই
দেশ থেকে অনেকেই ভাবেন প্রবাসে সোনার হরিণ আছে, গেলেই ধরা যাবে। প্রবাসে আসার পর তাঁরা ধাক্কা খান, তখন বাস্তবতা কি বোঝা যায়। থাকা-খাওয়া, চাকরি ও ভাষার সমস্যা—সব মিলিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে হয়। অনেকে তো ঠিকঠাক গন্তব্যেও পৌঁছাতে পারে না; হারিয়ে যায় পথেই।
মাত্র কিছুদিন আগে দেখলাম অভিবাসীবোঝাই একটি নৌকা লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে; নিহত হয়েছে ৬০ জন। এর মধ্যে ৩৭ জনই ছিল বাংলাদেশি। বাবা-মায়ের সম্পত্তি বিক্রি করে কত স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসের পথে পা বাড়িয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মাঝপথেই হারিয়ে গেল সে স্বপ্ন। তবু মানুষ ছুটছে প্রবাসে। একটু সুখের আশায়, ভালো থাকার আশায়। অনেকে কষ্ট করে অনেকে আসে শিক্ষার্থী ভিসায়, অনেকে আসে অভিবাসী ভিসায়। এসে প্রথম দিকে অসুবিধা হলেও পরে আস্তে আস্তে স্থির হয়। যে যেভাবেই আসুক না কেন, তাদের মাথায় দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের সুখে রাখার চিন্তাই থাকে শুধু। তার জন্যই তারা পরিশ্রম করে দিনরাত। সামনে আসছে ঈদ। এ ঈদ উপলক্ষে সবাই চেষ্টা করে দেশে ডলার পাঠাতে।
এই যে পরিবারের সঙ্গে প্রবাসী মানুষের এই যোগ, এটিই কিন্তু অনেকটা অলক্ষ্যে ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে। খবরে দেখলাম, ১ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গেছে ১৩৫ কোটি ৬ লাখ ডলারের। বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তাদের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠান, তা-ই গড়ে দেয় দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডটি।
সুখে-দুঃখে যেমনই কাটুক না প্রবাসীদের জীবন, তারা কিন্তু দেশের কথা ভাবে। ভাবে আপনজনের কথা। এমন হয়েছে অনেকে প্রবাসে আসার পর আর দেশে ফিরে যেতে পারেনি। এই যে যেতে না পারার দুঃখ, তা বুকের মধ্যে পুষে রাখে তারা। দেশে ফেরার আশা নিয়েই তারা পথ চলে। দেশে ফিরতে না পারার কারণের মধ্যে রয়েছে প্রবাসে আবার ফিরতে না পারার শঙ্কা। কারণ, অনেকেরই থাকে না বৈধ পারমিট। ফলে দেশে গেলে এখানে আবার ফিরে আসার সুযোগ থাকবে না। তারা দেশে ফিরতে না পারলেও অর্থ পাঠায় নিয়মিত, যোগাযোগ রাখে সবার সঙ্গে।
অনেকে ভাবেন, ‘একবার দেশে গিয়ে আর ফেরত আসতে পারব না। তাই যাব না। আর গিয়েই বা কী করব, সেই তো বেকার হয়ে যাব। ও পথে আর যেতে চাই না।’ এসব ভাবনা থেকেই অনেকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে বিদেশে, আর উপার্জনের অর্ধেকটাই দেশে পাঠিয়ে দেয়। প্রবাসীরা যে দেশ ও তাদের পরিবারকে কত ভালোবাসে, তার প্রমাণ হলো এই রেমিট্যান্স। প্রতি বছর রেমিট্যান্সের পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায় দেশের প্রতি প্রবাসীদের আবেগ। দেখা যায়, নিজে কোনো রকমে চললেও দেশে পরিবারের জন্য ঠিকই ভালো পরিমাণের অর্থ পাঠায় অনেকে। অনেকে আবার ধার করেও পাঠায়।
আসলে প্রতিটি প্রবাসীই যোদ্ধা। তারা জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলে। কিন্তু এত অবদান সত্ত্বেও প্রবাসীদের তাচ্ছিল্য করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হতে হয়। দেশে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় আছে, আছে প্রবাসীদের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংকও; কিন্তু হতভাগ্য প্রবাসীরা কি পেয়েছে? আসলে কিছুই না। বিষয়টির দিকে নজর দেওয়ার এখনই সময়। সরকারের কাছে অনুরোধ প্রবাসীদের প্রতি একটু খেয়াল করুন। অন্তত বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নিন। বিদেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগ নিন।
অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের অনেক কিছু করার আছে। প্রবাসে মৃত বাংলাদেশির লাশ সম্পূর্ণ সরকারি খরচে বাড়ি পৌঁছানোসহ ছোট ছোট উদ্যোগেই প্রবাসীদের দুঃখ লাঘব করা সম্ভব। খুব বেশি চাওয়া নেই প্রবাসীদের। যারা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিশেষত কারিগরি প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি সরকারি ব্যয়ে প্রদানের ব্যবস্থা করলে, প্রবাসে আসা মানুষদের জীবনযুদ্ধ যেমন সহজ হয়, তেমনি দেশেরও রেমিট্যান্স পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটু আন্তরিক হলেই এ কাজগুলো করা সম্ভব। করা উচিতও। যারা দেশে রয়েছে, তারা হয়তো জানেই না কত কষ্টে আয় করতে হয় প্রবাসে।
প্রতি বছর রেমিট্যান্সের হিসাব করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থের এ হিসাব করা হলেও এ ক্ষেত্রে কার কী অবদান তার কোনো স্বীকৃতি নেই। প্রতি বছর যদি শীর্ষ ৫০ জন রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীকে পুরস্কৃত করা যায়, একটি ভিআইপি কার্ড দিয়ে সম্মানিত করা যায়, তাহলে বিদেশ থেকে অর্থ আসার সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি প্রবাসীরা নিজ দেশ থেকে পাওয়া স্বীকৃতিতে কিছুটা হলেও সুখ খুঁজে পাবে। তার মনে হবে, না সে দেশের সঙ্গেই আছে। প্রবাসের কঠোর জীবনযুদ্ধে আরও দৃঢ়ভাবে লড়ে যাওয়ার রসদ পাবে তারা। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় চাইলেই কাজটি করতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির এই সময়ে এটি কঠিন কোনো কিছু নয়। শুধু প্রয়োজন একটি সিদ্ধান্ত। যারা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের জন্য দেশের জন্য এত কিছু করছে তাদেরই তো এগুলো প্রাপ্য। আমরা না হয় এই প্রাপ্য সম্মানটুকুই তাদের দিলাম।