নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব কোনো রোগ নয়

কেউ কোলাহলেও একা। কেউ সবার থেকে দূরে থেকেও একা। কেউ বা হাজার পাওয়ার ভিড়ে একা। দিন শেষে যদিও আমরা সবাই একা, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে কেন এই একাকিত্ববোধ বা নিঃসঙ্গতা?
অনেক বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন যে নিঃসঙ্গতা মানেই একা সম্পর্ক বা একা হয়ে যাওয়া নয়। বরং এটি মনের এমন একটি উপলব্ধি; যা আমাদের মনকে বাইরের সমস্ত যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যেমন ধরুন, আপনি বন্ধুদের মাঝে বা অফিসে অনেকের মাঝে থেকেও একা বোধ করছেন। প্রিয় মা-বাবা, ভাই বোনদের পাশে কিংবা ভালোবাসার মানুষটির পাশে থেকেও আপনি নিঃসঙ্গতা বোধ করছেন। আপনার মন হয়তো কিছু চাচ্ছে কিংবা একা থাকতে চাচ্ছে। আবার কখনো কখনো আপনি হতাশ হয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে যে, আসলে আপনার মন কি চাচ্ছে তাই খুঁজে পাচ্ছেন না।
আমাদের আদর্শ এবং অনুভূত সামাজিক সম্পর্কের মাঝে গোলযোগের কারণে যে মর্মপীড়ার তৈরি হয়, সেটাই নিঃসঙ্গতা। অনেক সমাজবিদরা মনে করে নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বিধিবিধান অনুসরণ করা থেকেই নিঃসঙ্গতার উৎপত্তি। আবার কিছু সাইকোলজিস্ট মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা, নিজের অনুভূতির যথার্থ প্রকাশ না করতে পারা এবং অধীনস্থ সামাজিক প্রক্রিয়া থেকেই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বের অনুভূতি চরম আকার ধারণ করে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক বিয়ে বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া।
অন্য একটি তত্ত্ব বর্ণনা করে যে, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি এবং ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য দুটি মিলে যখন সামাজিক সম্পর্ক গঠন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে মানুষ ব্যর্থ হয়, তখনই তারা নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। তখনই আসে একাকিত্ব অনুভূতি। জার্মান সাইকায়াট্রিস্ট ফ্রম্ম রিচম্যানের মতে, নিঃসঙ্গতা একটি আবেগের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে তাঁরা সংযুক্ত করেছেন মানুষের মনের সাধারণ অসন্তোষ। অসুখী, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, শূন্যতা ও একঘেয়েমি অনুভূতি। আন্তর্জাতিক যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও শিক্ষক রবার্ট এস উইসর একটি সংযুক্তি তত্ত্বে নিঃসঙ্গতাকে সামাজিক সম্পর্কের ঘাটতি, প্রতিপালন এবং একাকী অনুভূতির অবদান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, নিঃসঙ্গতা একটি ক্ষতিপূরণমূলক দীর্ঘস্থায়ী মর্মপীড়া। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবৈজ্ঞানিক এবং শীর্ষ নিঃসঙ্গতা বিশেষজ্ঞ জন কেসিয়াপ্পোর গবেষণা মতে, নিঃসঙ্গতা দৃঢ়ভাবে জেনেটিক্স সম্পৃক্ত।
সংজ্ঞা যাই হোক, মানুষ কেন একাকিত্বে ভোগে? একাকিত্বে ভোগার অনেক ধরনের কারণ আছে। বিশেষ কারণগুলো তুলে ধরা হলো

আত্মকেন্দ্রিক নিঃসঙ্গতা
এ ধরনের মানুষ ছোট বেলা থেকেই নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। হাজার কোলাহলে থেকেও, হাজার আনন্দে থেকেও ওরা যেন সবার থেকে আলাদা। একা থাকতে ওদের ভালো লাগে। ওরা অনেকটা দুঃখ বিলাসী।

সামাজিক নিঃসঙ্গতা
এ ধরনের মানুষ অসামাজিক হয়। ওদের মধ্যে সর্বদা ভয়, লজ্জা, বিতৃষ্ণা ও সংকুচিত ভাব থাকে। ওরা নিজেকে সামাজিক সম্পর্ক, আতিথেয়তা, আনন্দ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক অসৌন্দর্য্য, আর্থিক অসচ্ছলতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও দুর্বল মনোবল এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক নিঃসঙ্গতা
বুদ্ধিজীবী ও অতিমাত্রায় ইগো দ্বারা চালিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এ ধরনের একাকিত্ব লক্ষণীয়। এদের চিন্তা চেতনা ভিন্ন বিধায় এদের ব্যক্তিত্ব অনেকের সঙ্গে মেলে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই তারা এ ধরনের নিঃসঙ্গতায় ভোগেন।

মানসিক একাকিত্ব
অনেকে এটাকে মানসিক রোগ বলে থাকেন। এরা একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিজেকে কেবলই একা মনে করেন। এরা এক ধরনের মানসিক যাতনায় ভোগেন এবং কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভোগেন বলে কারও সঙ্গে কোনো কিছু ভাগাভাগি করতে পারেন না।

আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা
এরা খুব ভিন্ন হন। সাধু সন্ন্যাসী টাইপ চিন্তা ভাবনা করেন। “এসেছি একা, যাব একা, পৃথিবীতে কেউ কারও নয়” এই দর্শনে বিশ্বাসী বলেই এরা কোনো সম্পর্কে জড়ান না। এঁরা একাই জীবন উপভোগ করতে চান। তাই এঁদের অনেকেই নিঃসঙ্গতায় ভোগেন।
এগুলো ছাড়াও একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতায় ভোগার আরও কিছু কারণ আছে। যেমন:
—মা–বাবা যখন সন্তানকে বোঝেন না কিংবা সন্তান যখন মা বাবার অবাধ্য হন, তখন উভয় পক্ষই একাকিত্বে ভোগেন। নতুন অবস্থা, নুতুন স্কুল কলেজে একাকিত্ব বাড়ে। ভঙুর পরিবারের সদস্য বা পরিবারে মা–বাবার অসামঞ্জস্য সম্পর্কে সন্তানেরা একাকিত্ব বোধ করেন। বিবাহ বিচ্ছেদ, অনিচ্ছায় জোরপূর্বক বিয়ে, সম্পর্কে শিথিলতা বা সমঝোতার অভাব, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব, শ্রেণিভেদ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ভিন্ন সংস্কৃতি, আর্থিক অসচ্ছলতা ও শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ।
একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার কারণ যাই হোক, এটা কাটাতেই হবে। কারণ দীর্ঘমেয়াদি একাকিত্ব মানুষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। সম্প্রতি এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবং গবেষকদের দাবি এই যে নিঃসঙ্গতা মানুষের রক্তচাপ বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল করে দেয়। তারা সহজে অবসাদ কিংবা ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিভ্রংশ বা ভাবনা-চিন্তায় অসংগতির মতো স্নায়বিক রোগ) শিকার হতে পারেন, এমনকি হৃদ্‌রোগেও আক্রান্ত হতে পারেন। রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। কমতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং হার্টের রোগ, ডিমেনশিয়া হতে পারে। গ্রাস করতে পারে ডায়াবেটিস, অবসাদ। বয়স্কদের হঠাৎ মৃত্যুও ঘটতে পারে। নিঃসঙ্গতা মানুষকে শুধু অসুখীই করে না, মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দেয়।
তাই দীর্ঘ মেয়াদি একাকিত্ব কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব ঘোচাতে নিজ চেষ্টাযর পাশাপাশি, পরিবার ও বন্ধু মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে। একাকিত্ববোধ কোনো মানসিক ব্যাধি নয়। তবে এটা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়, তখন মানুষ মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তাই একাকিত্ব দূর করতে কিছু সহজ পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন- বন্ধুদের সঙ্গে গেট টুগেদার করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। পড়াশোনা, চাকরি, দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি সম্ভব হলে শরীরচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন। সমাজ সেবামূলক কাজ করুন। মানবতার কাজে এগিয়ে যান। এতে মনে এক প্রকার শান্তি ও প্রফুল্ল আসে। অবসর সময়ে ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল কিছু করুন। কিংবা টিউশনি করুন। এতে বাড়তি কিছু আয়ও হবে।
পরিবারের সঙ্গে বেশি বেশি সময় দিন। ছোট ভাই বোন থাকলে, ওদের সঙ্গে ফান করুন। গল্প করুন। মাকে রান্না ঘরে সাহায্য করুন। কিংবা বাবার পাশে কিছুক্ষণ গল্প করুন, তার সেবা করুন। সন্তান থাকলে, তাকে নিয়ে খেলা করুন। সন্তানের সঙ্গে বাইরে বের হন। গল্প করুন।
কমিউনিকেশন (বাক্যালাপ) করুন। পরিবারে মা–বাবা অথবা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্ভব হলে কথা বলুন। আপনার সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করুন। নিজে যতই বিখ্যাত বা কুখ্যাত হোন, বন্ধু মহলে তা জাহির না করে, সহজ স্বাভাবিক আচরণ করুন যেন অপর পক্ষ আপনাকে প্রতিপক্ষ না ভেবে বন্ধু হিসেবে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে। একাকিত্ব কাটাতে লেখার অভ্যাস করুন। অনেক বড় বড় লেখকরাই তাদের জীবনে কোনো এক সময় নিঃসঙ্গতার অনুভব করেছিলেন।
একাকিত্ব সব সময় যে খারাপ তা নয়। সৃজনশীল মানুষ একাকিত্বকে কাজে লাগিয়েই বিখ্যাত হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো বিখ্যাত কবিও তাঁর একাকিত্ব থেকেই কোনো এক সময় লিখেছিলেন,
“আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে।
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে”!

লেখক: এডুকেটর, ফ্লাশিং, নিউইয়র্ক