পাত্র বাছাইয়ে বিড়ম্বনা

সিলেটের জেলা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এক বনেদি গ্রামে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে তিন–তিনটি বিবাহযোগ্য মেয়ে। নানা জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু কোনোটির শুভ সমাপ্তি হয় না। অনেক তত্ত্ব-তালাশের পর আসল কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা লোকজন বাড়িতে আসার আগে স্থানীয় বাজারে বিশ্রাম নিতে বসেন, নয়তো মিঠাই-মন্ডা কিনতে নামেন। এলাকায় নতুন লোকজন দেখে সবাই তাঁদের খোঁজ নেন। কোথায় এলেন, উদ্দেশ্যই বা কী—এসব নিয়ে তাঁদের অনেক কৌতূহল নিবৃত্তির প্রয়াস। বিয়েশাদির বিষয় নিয়ে এসেছেন শুনে এলাকার চেয়ারম্যান উপস্থিত। সব শুনে বরপক্ষকে মাত্র ওই পরিবারের মেয়েদের জন্য দুটি প্রশংসাবাণী দিলেন। সরাসরি বলেই দিলেন, এই বংশধর বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ করতে পারা তো সাতরাজার ধন পাওয়ার শামিল, পূর্বপুরুষের কোনো সুকর্মের ফল!
বিবাহযোগ্য মেয়েদের প্রশংসা করতে গিয়ে বলে দিলেন, ওই বাড়ির মেয়েরা যেমন রূপে-গুণে সেরা, তেমনি শিক্ষাদীক্ষায় অনেক আগুয়ান। এ ছাড়া বাড়িতে কাজের এত লোকজন যে তাদের নিজের হাতে কখনো এক কাপ চা পর্যন্ত তৈরি করতে হয় না। এত এত সুন্দর সুন্দর প্রশংসা (?) শুনে বরপক্ষের কি আর ইচ্ছে হবে এই পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করতে! সেই প্রশস্তি-বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে ওই পরিবারকে শেষ পর্যন্ত শহরে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, তারপর ওই পরিবারের মেয়েদের বিয়েশাদি হয়েছিল।
কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় তো কোনো চেয়ারম্যান নেই, যিনি বিয়েশাদিতে নানা অসত্য কথা বলে বিয়েতে ভজঘট সৃষ্টি করবেন। তা ছাড়া ইংল্যান্ড-আমেরিকায় দেশের মতো হাটবাজারে হবু বধূর খোঁজ নিতে হয় না বটে। তারপরও কেন আজকাল বিবাহযোগ্য মেয়েদের মা-বাবার দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না! মেয়ের স্বাভাবিক বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না উপযুক্ত পাত্রের অভাবে। তারই কারণ অনুসন্ধানে কিছুটা পেছনে ফিরে যাওয়া।
আমেরিকায় বসবাসরত অধিকাংশ মা-বাবারই সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যায়। প্লে গ্রুপ থেকে সব সময় একটি মাত্র চিন্তা ছেলে অথবা মেয়েকে, পারুক আর না–ই পারুক, ফার্স্ট হতে হবে! মেধায় কুলাক আর নাই কুলাক সব বিষয়ে হতে হবে এক নম্বর। শুধু লেখাপড়া নয়, সংগীতচর্চা, নৃত্যকলাসহ সব শাখায় প্রথম কাতারে থাকতে হবে। সন্তানের আগ্রহ আছে কি না, মা-বাবার তা-ও দেখার সময় নেই। প্রয়োজনে বিশেষায়িত স্পেশালাইজড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এনরোলমেন্ট পেতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিযোগিতা থেকে এমনটি হয়ে থাকে। খালাতো বোনের ছেলে কিংবা ননদের মেয়ে নামকরা নানা টেক স্কুলে পড়ে। এখন আপন সন্তানেরা সাধারণ স্কুলে পড়লে তো মানসম্মান গেল! জন্মবার্ষিকী অথবা বিবাহবার্ষিকীতে মেহমান হয়ে গেলে সবার সন্তানদের স্পেশালাইজড স্কুলের গল্পের সঙ্গে
নিজের সন্তানদের নিয়ে গল্প না করতে পারলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।
এমন হয়েছে, বাবার আর্থিক সংগতি না থাকলেও শুধু নিজেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতার ফলে ধারকর্জ করে হলেও সন্তানদের বিশেষ স্কুলের জন্য প্রস্তুত করছেন। কেউবা সফল হয়েছেন কেউবা বিফল। তবু হাল ছাড়েননি। এক সন্তান যদি কৃতকার্য না হয় তবে পরের সন্তানের ওপর চলতে থাকে তাকে ট্যালেন্ট বানানোর অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এর ওপর চলে আবার নানা ধরনের খবরদারি, যার একটি হলো বন্ধু নির্বাচন। ছেলেদের ব্যাপারে এত মাথা না ঘামালেও মেয়েদের ওপর চলে পুরোদমে গুপ্তচরবৃত্তি। তার সেলফোন চেক করাসহ ফেসবুক প্রোফাইলে নিয়মিত হানা দেওয়া মায়েদের সবচেয়ে জরুরি কাজ। ভিনদেশি বন্ধু নির্বাচনে শতভাগ নিষেধাজ্ঞা অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারে। মেয়েদের ব্যাপারে শুধু ভিনদেশি মেয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে ওঠাবসাতে কখনো ছাড় দেওয়া হয়। মেয়ের ছেলেবন্ধুর তো প্রশ্নই ওঠে না।
মজার বিষয় অভিভাবকদের সেই নজরদারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত চলতে থাকে। বিদেশি বন্ধু নির্বাচনে যখন বাধা থাকে, সেখানে নিশ্চয় দেশি কোনো ছেলে বা মেয়েকে বন্ধু বানাতে অথবা ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিনী ভাবতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। না, সেখানেও সমস্যা আছে। দেশি বন্ধু নির্বাচনে বন্ধুদের বিশদ বিবরণ তথা সে কোন জেলার অধিবাসী, পারিবারিক পদবি কী ইত্যাদি জানতে হবে! বাবা কি সরকারি চাকরি করতেন না ব্যবসায়ী ছিলেন। সে অনেক লম্বা প্রশ্নমালা। যার শেষ অংশ কোথায়, না জানে সন্তান, না জানেন অভিভাবকেরা। বিষয়টি যখন সন্তানের সুতরাং তারই কাঁধে এসে চাপে দুনিয়ার সব চাপ।
বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো অভিভাবকদের অনেক জিজ্ঞাসার প্রধান জিজ্ঞাসা থাকে ছেলের নামের শেষে চৌধুরী তথা ভালো পদবি আছে কি না। তা না হলে তো সর্বনাশ। বিশেষ করে কিছু মা-বাবার তো চিন্তার শেষ নেই। বড় ভাবনা যদি মেয়ের পছন্দমতো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। ছেলের নামের সঙ্গে যদি চৌধুরী না থাকে, তাহলে পরিবারসহ সমাজের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে! সবাই ধরে নেবেন মেয়েটির কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। এখানে ছেলের মেধা বা ব্যক্তিত্ব যতই উপযোগী হোক না কেন তা বিবেচনায় আসবে না। তার নামের আগে বা পরে টাইটেল কী, তা বিশেষ খেয়ালযোগ্য।
যার প্রভাব সরাসরি বিবাহযোগ্য মেয়েদের ওপর এসে পড়ে। সে সারাক্ষণ থাকে সিদ্ধান্তহীনতায়। বন্ধু নির্বাচনে যেখানে মূল বিষয় হওয়া উচিত শিক্ষাদীক্ষা বা ব্যক্তিত্ব, সেখানে তা না হয়ে বংশ-পদবির বিষয় হয়ে পড়ে মুখ্য। তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সমাজে এই চর্চা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মেয়েরা ভালো লেখাপড়া করে অনেকাংশেই উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে বা এখনো প্রক্রিয়ায় আছে। ওরা কখনোই পড়াশোনা চলাকালে বিয়ে করতে রাজি নয়। যখন উচ্চতর ডিগ্রিধারী হলো, তখন তার সমকক্ষ কোনো পাত্র পাওয়া বড়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ, ছেলেরা ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি বিয়ের ডিগ্রি অনেকাংশে সময়মতো সেরে ফেলে। তা ছাড়া বয়স, পদবি, জেলাসহ আরও বিষয়াদি তো আছেই!
ভালোবাসার শহর নিউইয়র্কে স্থায়ী ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টিতে আজ অনেক বিষয় অভিভাবক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা না পারছে সন্তানদের সর্বোচ্চ শিক্ষাদানের আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত রাখতে, না পারছে সঠিক সময়ে সন্তানদের বিয়েশাদির আয়োজন করতে। সে জন্যই হয়তো আমাদের অভিভাবকদের নতুন ভাবনার সময় এসেছে সন্তানদের সঙ্গে বসে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার। ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক কিংবা বিয়েশাদির বিষয়ে যুগোপযোগী ভাবনার জানালা খুলে দেওয়ার।