প্রবাসী মায়ের শূন্যতা

আমার বয়স এখন বাষট্টি। শাশ্বত সুন্দর সবুজের মধ্যে নেতিয়ে পড়া এক হলদে ফুল। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এখনো আমি সতেজ ফুলের সমারোহে বাগানের এক কোণে ঠাঁই গেড়ে আছি। ওরা আমাকে শিকড় ওপরে ছুড়ে ফেলেনি! ধন্য আমি, ধন্য।
ছেলে আমার মস্ত বড়, শুধু বয়সে নয়, পেশাগত জীবনেও। ছেলের বউ ব্যাংকার। খুব ব্যস্ত জীবন তাদের। নাতনিরা দুজন সবে হাঁটিহাঁটি পা পা করছে! যমজ ওরা। ছেলে, বউমা অফিস করে আটটা থেকে চারটা। এ সময় বাচ্চারা আমার কাছেই থাকে। জ্বালাতন একদমই করে না। ওদের মুখে ডাল চটকানো ভাত দিতে হয় না, ওরা ক্যান ফুড, প্যাকেট ফুড খায়। ফুল তোলা নকশি কাঁথা ধুতে হয় না, প্যাম্পার্স খুলে আবর্জনায় ফেললেই হয়। সাবান ডলে গোসলও দিতে হয় না! ওদের মা গোসল দেয়; যদি আমি ব্যথা দিয়ে ফেলি! খাটুনি বলতে গেলে কিছুই নেই সংসারে। শুধু নাতনিদের দেখাশোনা করা। এ আর এমন কী! ওরা তো আমারই!
ছেলে, বউমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো। কখনো মনোমালিন্য হয় না। আসলে কথা বলার সময়ই নেই তাদের, খুব ব্যস্ত। শুধু ছুটির দিন কিছুটা কথা হয়। মাঝে মাঝে ছুটির দিন সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে যায়! ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার দেখা হয়নি কোনো দিন। আজ ছেলে আমায় বিমানে চড়িয়ে আমেরিকায় এনেছে কনি আইল্যান্ড, জন বিচ, নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখাবে বলে। স্বপ্নের দেশে সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগে। কত কি আছে এখানে! স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, গ্রিল, বেইকড, অরগানিক, আধা সিদ্ধ, ভেজিটেবল জুস, আরও কত কী! ছেলে-বউমাকে ডাল চচ্চড়ি-ট্যাংরার ঝোল রেঁধে খাওয়াতে হয় না। ওরা খায় উন্নত খাবার, আমিও তাদের সঙ্গে খাই। বউমাকে নিয়ে দুধে সর ফেলা চা খাওয়া হয়নি কখনো, বউমা খায় ব্ল্যাক কফি!
সন্ধ্যায় ওরা বাড়ি ফিরলেই নাতনিরা দৌড়ে যায়। আমার তখন খুব একা লাগে! ছেলে বলে, মা বিশ্রাম নাও। বউমা বলে, মনে করে ডিনার সেরে নেবেন মা! আহা! কত খেয়াল রাখে আমার!
আমার তখন অফুরন্ত সময়! এক কাপ চা হাতে জানালার পাশে গিয়ে বসি। আঁধার কালো রাতের আকাশ আজকাল বড় ভালো লাগে। আঁধার আমায় এক ধরনের শূন্যতার হাহাকারে তলিয়ে দেয়। এর উৎস উদ্ভাবনে কাটিয়ে দিলাম তিনটি বছর আমেরিকার আকাশতলে, আজও সে হাহাকারের উৎস উদ্ভাবন হলো না।
ভাবনার মেঘলা আকাশে হঠাৎ বৃষ্টির ঢল নামে! সে বৃষ্টিতে মন ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়! মনে হয়, কত দিন আকাশ দেখি না, সোনা রোদ ঝরঝরে আকাশ; আমার প্রিয় আকাশ! বৃষ্টিতে হাঁটুজল থই থই উঠোন, সেখানটায় কাগজের নৌকা ভাসিয়ে কতক শিশু খেলা করে না। মনে পড়ে, খোকার বাবা শুঁটকির গন্ধ একদম পছন্দ করত না। তবু আমার ভীষণ পছন্দ বলে চিটাগং থেকে শুঁটকি আনাতো লোক দিয়ে। বিকেল হতেই নিজ হাতে সরপড়া চা করে আমাকে নিয়ে বসতো বারান্দায়। টুকিটাকি সংসারের কথা শুনতে চাইতো। আমি বলতাম, সবে অফিস থেকে ফিরলে! একটু জিরিয়ে নাও। খোকার বাবা বলত, সারাটা দিন একা একা কত কাজ করো! সময় দিতে পারি না। একটু গল্প করি!
মনে পড়ে, যখন সেঁজুতি আসত বাচ্চাদের নিয়ে, খুব হইচই হতো বাড়িতে। রুনু আর ঝুনু সারাক্ষণ আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকত। রাতে আমাকে ছাড়া ঘুমাত না। রাতভর ভুতুম প্যাঁচার গল্প শোনাতে হতো। সেঁজুতি রাগ হতো। বলত, মা! ওদের এত আশকারা দিয়ো না তো! তোমার জান শেষ করে ছাড়বে! আমি হাসতাম! ভাবতাম, এ সুখটুকু ক’জন পায়!
খোকা আর সেঁজুতি যখন ছোট, সবে স্কুলে যায়, পরীক্ষার পর স্কুল ছুটিতে চলে যেতাম গ্রামে বাবার বাড়িতে। ওদের বাবা চাকরির কারণে থাকত শহরে। কী যে ভালো লাগত আমার গ্রামে যেতে! এমন আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, সুশীতল মনোরম ছায়া, মাচায় ঝুলে থাকা শসা, লাউ, ধান খেতের পাশের চিকন সরু রাস্তা, দূর থেকে মনে হতো যেন বিলি কাটা চুলের সিঁথি।
ভোর হতেই মুরগির কুক্কুরুক্কু ডাকে ঘুম ভাঙত। কুয়াশা ভোরে চাদর গায়ে, গায়ের পথে বের হতেই খেজুরের রসের লোভ আমাকে পেয়ে বসতো। সন্ধ্যা হতেই ঝি ঝি পোকার ডাক; কী যে ভালো লাগত!
ভরা পূর্ণিমায় আকাশের চাঁদটাকে মনে হতো সদ্য মাঝা রুপোর থালা। এমন আলো গ্রাম ছাড়া আর কোথায় দেখা যায়! এখানকার আকাশে চাঁদ তো উঠে, সে চাঁদ মনের গভীরে কোনো আলো ফেলে না। এত নিরাপদ জীবন এখানে, তবু কেন যেন মন মানে না। ভাবি, কবে যে বাড়ি যাব! আমার বাড়ি, আমার শহর, মাটি-মানুষের ঘ্রাণ। কবে যে শুয়ে পড়ব ধান খেতে বিছানো সোনালি গালিচায়, দুই ধারে সবুজ, ওপরে নীলা, কাদা জলে মাখামাখি গ্রাম্য স্মৃতি...!
চাইলেই কি সব পাওয়া হয়! ছেলে, বউমা, নাতনিদের ছেড়ে কোথায় যাব! আমাকে যে ওদের বিশেষ প্রয়োজন। সবে তো ওরা হাঁটা শিখছে, বউমার বেবি সিটার একেবারেই পছন্দ না। ছেলে বলে, মা, তোমার কাছে মেয়ে দুটোকে রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করি! শুনেছি ছেলে বাড়ি কিনবে। অনেক টাকা দরকার। দুজনে কাজ না করলে কি চলবে? তা ছাড়া আমি চলে গেলে বেবিসিটারের বাড়তি খরচ!
বুড়ো হলে কত বিচিত্র সব ভাবব না যে আসে! শেষ সময়ে এত আবেগী হলে কি হয়? আমাকে আমেরিকা আনতে ছেলে আমার কত টাকা খরচ করল, কত বড় বাড়ি নিতে হলো আমাকে রাখবে বলে! থাক, না হয় আরও কয়টা বছর থেকেই যাই।