প্রাণ ফিরছে নিউইয়র্কে

ছুটির দিনে সেন্ট্রাল পার্কে নগরবাসীর ভিড়

নিউইয়র্কে নগরে সৎকারের অপেক্ষায় এখনো ফ্রিজার ট্রাকে পড়ে আছে এক বছরের পুরোনো মরদেহ। তবে করোনা মহামারির সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে এই নগর। নাগরিকেরা টিকা নিচ্ছেন, প্রতিদিনই বাড়ছে নাগরিকদের টিকা গ্রহণের হার। মাস্ক ব্যবহারে রাজ্য সরকার কিছুটা শিথিলতা দেখালেও করোনা থেকে বাঁচতে এখনো বাইরে বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন। এক–দেড় বছরের করোনার বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে এখন ব্যাকুল নিউইয়র্কবাসী। একটু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই পুরোনো চেহারায় ফিরতে মরিয়া নগরবাসী।

গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর পর থেকে ছুটির দিনে সৈকত, পার্ক, চিড়িয়াখানাসহ বেড়ানোর স্থানগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। জাদুঘরে প্রবেশেও দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে ছুটছে নগরের বাইরের কাউন্টিগুলোতে। অনেকে আবার ভিন্ন অঙ্গরাজ্যের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বেড়াতে বেরিয়েছেন প্রায় দেড় বছর পর। যেন এক মৃত্যুপুরির প্রাণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে।

নিউইয়র্ক নগরের স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৭ মে পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে নগরে মারা গেছে ২৭ হাজার ৯৪৫ জন। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৮ জন। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির চিত্র কিংবা করোনার ভয়াবহতা সময়ের কাঁটার সঙ্গে ছুটে চলা এই নগরে কতটা শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, ম্যানহাটনের আবাসিক ভবনগুলোতে ঝুলতে থাকা ভাড়ার সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।

তবে নাগরিকদের টিকা গ্রহণের প্রবল আগ্রহ আশার সঞ্চার করছে নাগরিক জীবনে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ১৭ মে পর্যন্ত অন্তত এক ডোজ টিকা নিয়েছেন ৪৭ শতাংশ মানুষ আর দুই ডোজ টিকা নেওয়া মানুষের হার ৩৯ শতাংশ। সংখ্যায় টিকাগ্রহীতা হচ্ছেন ৩২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৪ জন। টিকা গ্রহণের হার বৃদ্ধি ও গড়পড়তা তাপমাত্রার মধ্যেই গত ১৩ মে থেকে ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রার সুবাদে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে নগরবাসী।

ঘুরে দেখা গেছে, ছুটির দিন হলেও গত শনি ও রোববার কর্মদিবসের চেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে নিউইয়র্ক নগরের সাবওয়ে ও বাসে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দিকেও ব্যক্তিগত গাড়ির জটলাও ছিল চোখে পড়ার মতো। নগরের বৃহত্তম বিনোদনের স্থান সেন্ট্রাল পার্ক, প্রসপেক্ট পার্ক, ফরেস্ট হিল, ব্রুকলিন ব্রিজ, কোনি আইল্যান্ড বিচ, রকওয়ে বিচ, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ব্রঙ্কস জু, নিউইয়র্ক অ্যাকুরিয়ামসহ বেড়ানোর জায়গাগুলোতে ছিল মানুষের ভিড়। কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন রিভার ক্রুজের মতো উপভোগ্য ভ্রমণও। বেড়ানোর এই তালিকায় পারিবারিক ভ্রমণই বেশি দেখা গেছে।

শুধু বেড়ানোর স্থানই নয়, ভিড় ছিল জাদুঘরেও। ম্যানহাটনের দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে ঢুকতে সামাজিক দূরত্ব মেনে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন মনে করিয়ে দেয়, নগবাসীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কতটা উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে।

নগরের বৃহত্তম সেন্ট্রাল পার্কে পিকনিক, জন্মদিনের পার্টি, গ্র্যাজুয়েশন পার্টিসহ নানা পার্টির আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। ছোটদের মাছ, কচ্ছপ, ফুল, পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দেখো গেছে অভিভাবকদের। নবদম্পতির বিয়ের ছবি তোলা। সূর্যস্নান কিংবা প্রখর রোধে ধ্যান কিংবা মেডিটেশন করতেও দেখা গেছে দর্শনার্থীদের। লেকে নৌকা ভ্রমণ, মাঠে খোলাধুলায় মেতেছিল তরুণ-তরুণীরা।

ম্যানহাটনের হৃৎপিণ্ড সেন্ট্রাল পার্কের নর্থ উডের শান্ত ঝরনা, কনজারভেটরি গার্ডেন, স্ট্রবেরি ফিল্ড, চেরি হিল, পিলগ্রিম হিলসহ বেড়ানোর স্পটগুলোতে ঘোরাঘুরি করে যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে দর্শনার্থীরা। টল ফ্যামিলি প্লে-গ্রাউন্ড, সাফারি প্লে-গ্রাউন্ডসহ ছোটদের বিনোদন স্পটগুলো ছিল শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত। লেকগুলোতে মৎস্য শিকার ও নৌকা ভ্রমণে যেন আনন্দের শেষ নেই। সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে পার্কের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রেট লনে। বিশাল এই মাঠের চারপাশে অগণিত পার্টি চলেছে দিনভর। বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশি পরিবারের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। আর বেড়ানোর স্থানগুলোতে আগত দর্শনার্থীদের বিনোদন দিতে মিউজিক্যাল পার্টিগুলো বিরতিহীনভাবে গান–বাজনা পরিবেশন করেছেন।

ছেলে–মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসা বাংলাদেশি মার্কিন বংশোদ্ভূত কানিজ সুলতানা রীতিমতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে তাঁরা সর্বশেষ বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর তিনি নিজে ও সন্তানদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে বের হননি। সেই হিসাবে দেড় বছরের বেশি সময় পর বেড়াতে বের হলেন। সন্তানদের আবার প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছেন। সবচেয়ে বড়কথা, নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে বহুদিন পর। সবাই যার যার মতো আনন্দ করছে, এটা দেখে ভালো লাগল।

ক্যাপ: এ যেন মৃত্যুপুরী থেকে বের হওয়ার চেষ্টা। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর পর নিউইয়র্কের মানুষ দলে দলে বেড়াতে বের হচ্ছেন। ছবি: রুদ্র মাসুদ