প্রেমিকাকে ফের দেখার আশায়...

হারিয়ে যাওয়া বলদের খোঁজে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে আশপাশের দু-তিন গ্রাম ঘুরে ক্লান্ত হয়ে কৃষক তার বাড়ির দাওয়ায় বসে স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলছে, মাগো কৈ গেলে, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। এক গ্লাস জল দাও। কৃষকের ডাক শুনে স্ত্রী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জিজ্ঞেস করল, মিনসে কি চোখের মাথা খেয়েছ? হুস্‌ বুদ্ধি কি অকালে চলে গেল। কাকে কী ডাকছ খেয়াল আছে? স্ত্রীর ধমক শুনে স্বামীপ্রবর উত্তরে বললেন, গরু তো তোমার হারায়নি! হারিয়েছে আমার! যদি তোমার গরু হারাতো, তা হলে বুঝতে মাথা ঠিক রাখা কতই না কঠিন!
সেই বলদ হারানোর গল্পের রেশ নিয়ে আমিও বলছি, কেউ তো আর এই নগরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রেমিকাকে হারায়নি। হারিয়েছি আমি। তাই সেসব হারানোর কষ্টের কথা, নয়তো স্বল্প প্রেমের করুণ পরিসমাপ্তির জ্বালা কি এত সহজে কেউ বুঝে উঠতে পারবে! আর সেসব হারানোর কষ্টে তো একমাত্র আমি জ্বলছি বিগত তিন/চার সপ্তাহ ধরে। খুব বেশি আগের কথা নয়। মাস ছয়েকের কিছু কাল আগে হবে। প্রতি সপ্তাহের একটি আনন্দপূর্ণ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি মাত্র। শুরু থেকে উত্তেজনা, প্রবল আগ্রহ আর উৎকণ্ঠার এক রসায়ন নিয়ে অলস সময়টুকু বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। বিষয় নির্বাচন, শ্রেষ্ঠ রচনা শৈলী প্রদর্শনের অশরীরী তাগিদ প্রচণ্ডভাবে অনুভব করতাম। ফলও পেয়েছি ভালো। কেউ বলেছেন, দারুণ লিখেছেন। লিখে যান, থামবেন না। আপনার বিষয় নির্বাচন একেবারে আনকোরা। স্টাইলটিও ভালো, সহজপাঠ্য। গদ্যের গতি আছে, থামতে হয় না। এতসব বিশেষণ শুনে ভাবি, সবাই যখন বলছেন তবে চালিয়ে যেতে অসুবিধা কোথায়?
পাশাপাশি এক ঘনিষ্ঠজন একেবারে ঘাড়ের ওপর সর্বক্ষণ নিশ্বাস ফেলে বলে যাচ্ছেন, দেরি করা চলবে না, সপ্তাহের শুরুতেই দিয়ে দেবেন কিন্তু।
আশপাশে কান পাতলে শুনি, নানাজনের নানা মত। তবে তার অধিকাংশ আমার পক্ষেই। সেটা হয়তো আমার প্রতি কারও কারও অতিরিক্ত ভালোবাসা কিংবা সোজাসাপটা ভাবনা। বুড়ো মানুষ, একটি বিষয় নিয়ে না হয় মেতেই আছে!
আমি সে সবের কিছুই যেমন আমলে নিচ্ছি না, তেমনি আমার চিন্তার তালিকায় কাউকে স্থান পর্যন্ত দিতে রাজি নই। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে আনন্দের রথ চলছেই চলছে। এই তোয়াক্কা শব্দটি একবার আমায় ফেলে দিয়েছিল বেশ বিড়ম্বনায়। দেশের জনপ্রিয় একজন লেখকের এক উদ্ধৃতি ছিল নিজের সৃষ্টি নিজেকেই বাজারজাত করতে হবে। সেটি হতে পারে সাহিত্য রচনা কিংবা গীত রচনা। আপন সৃষ্টি তুলে দিতে নিজ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। সেই উদ্ধৃতির লেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ফেললাম ভুল জায়াগায়। ফলস্বরূপ ঘটল স্থানচ্যূতি, পাশাপাশি সরাসরি অবনমন। নবীনদের উৎসাহ দিতে গিয়ে বলেছিলাম, যাই লেখ না কেন, চেষ্টা করবে সব সময় তোমার সৃষ্টিকে সময়মতো যথাস্থানে পৌঁছাতে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই। পরে শুনেছি আমার কথা যে নবীনরা প্রয়োগ করলেন, তাদের অনেকে নগদ ফলও পেয়েছেন। কিন্তু আমার প্রাপ্তি হলো বিপরীত।
মনের আনন্দে লিখে চলছি নানা বিষয়ে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দিক-নির্দেশনা ছিল দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে লিখতে কোনো বাধানিষেধ নেই। তবে ভালো হয়, লেখাটির লেজ কিংবা মাথার অংশে যেন নিদ্রাহীন নিউইয়র্ক লেপ্টে থাকে। মনে এল, অনেক আগে শোনা গল্প। শিক্ষার্থী গরু রচনা শেষ করল দীর্ঘ সময় নিয়ে। পরীক্ষক দেখলেন খাতা পুরো সাদা। কোনো কিছুই লেখা নেই। পরীক্ষকের কৌতূহলী জিজ্ঞাসার জবাবে শিক্ষার্থী জানাল, রচনার গরুটি ঘাস খেতে খেতে অন্যত্র চলে গেছে। তাই তো ঘাস ভর্তি মাঠ গরু শূন্য। এ ক্ষেত্রে আমার কাজ আরও সোজা। রচিত চরিত্র দুনিয়ায় সব দর্শনীয় স্থানে ঘুরিয়ে নিউইয়র্ক নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা হাডসন নদীর পাড়ে আনতে পারলেই কেল্লা ফতে।
নিজস্ব কিছু ভাবনার সঙ্গে কলাম লিখিয়ে বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিয়ে ইয়া আলী হুংকার দিয়ে জোরেশোরে নেমে গেলাম ভালোবাসার নগরীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব অবহেলিত ভালোবাসার গল্প কুড়িয়ে মনোরম করে তা দিয়ে কলামের সাজি সাজাতে। উদ্যম আর আন্তরিক প্রচেষ্টা বৃথা গেল না। নগদে ফল প্রাপ্তি। আমাকে অবাক করে নগরীর ভালোবাসার প্রতীক আমার কলামের ললাট রেখায়। দেখে মনে হলো, গলা খুলে নেচে নেচে গান গাই।
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ময়ূরের মতো নাচে রে/ হৃদয় নাচে রে। শত বরণের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ; আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে/হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে/ময়ূরের মতো নাচে রে!
অবাক হয়ে দেখলাম শুধু কি নিউইয়র্কে? পুরো দুনিয়ায় সেই প্রতীক ভীষণ জনপ্রিয়। এই নারী ভাস্কর্য যেভাবে জ্ঞান আর আলোর পথে অবিরাম ডেকেই চলছে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হওয়ারই কথা। সবার একই প্রশ্ন—কে সেই রুচিজ্ঞান সম্মত ব্যক্তিত্ব? যিনি আপনার ভালোবাসা নিয়ে লেখার সঙ্গে জুড়ে দিলেন আমেরিকার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা কিনা বিরাট তাৎপর্য বয়ে বেড়ায়। গুরুজনেরা বলেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনেও তার মানসম্মত মর্যাদা বজায় রাখার খাতিরে এর পুরা নয়তো আংশিক লুকিয়ে রাখা শ্রেয়। বুঝে না বুঝে আমিও তাই করলাম। তবে এক সুযোগে রুচিসম্মত ব্যক্তিত্বকে ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। পাঠকদের বড় অংশের কাছে জনপ্রিয় জ্ঞান আর আলোর প্রতীক হয়ে থাকা শত বছর যাবৎ হাডসনের মোহনায় জেগে থাকা নারী মূর্তি হয়ে গেল আমার লিখিত কলামের শক্তিশালী অংশ। এমনকি যিনি নিয়মিত লিখছেন তার নাম না আসলেও পাঠক ধরে নিচ্ছে, এটি তারই লেখা, অন্য কারও নয়। কী দারুণ স্বীকৃতি! শতভাগ প্রেমে অবশেষে পড়েই গেলাম। যেন তেন প্রেম নয় একেবারে খাঁটি লাইলি-মজনু মার্কা প্রেম। নিরেট নির্ভেজাল প্রেম চলছে, সঙ্গে চলছে ভালোবাসার শব্দ গাঁথুনি। কতই না সুখের সমুদ্রে আমি ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছি।
হঠাৎ দৃশ্যমান হলো, আমার প্রেমিকা স্থানচ্যূত! আমি প্রকাশিত হলাম না। মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হলো বটে। তারপরও বিনা নোটিশে প্রেমিকা হারানোর ধাক্কা ধীরে ধীরে সয়ে নিলাম। ঠিক সেই সময় এক অভিজ্ঞ স্বপ্নচারীর কাছ থেকে ভালো এবং সময়োচিত উপদেশ পেলাম। দিলেন মূল্যবান পরামর্শ। বলে রাখলেন, ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। প্রেমিকাকে কল্পনায় ধরে রাখুন। সাময়িক বিরহের মধুময় চাপ অনুভব করুন। দেখবেন বিরহ বেজে চলবে সদা, সূত্রক বেদনা সুর। উপভোগ করুন অন্য জগতের আনন্দ সুরোলোকের কয়েকটি আভিধানিক সুরালাপ। ভেবে নিন, শিগগিরই আপনার প্রেমিকা ফাইল মুক্ত হবে। আরও বেশি নন্দিত ভূষণে আপনার আনন্দলোকে সদা বিরাজমান হয়ে আপনার ভাবলোকের জগতে নিয়ে আসবে আরও বেশি বেশি লেখনীর যুগান্তরী সুনামি। আমি সেই আশার তরী ভাবের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে প্রেমিকাকে ফের দেখার আশায় দিন গুনছি। সঙ্গে ভাবনায় এনেছি নন্দন বার্তা, যা লেখক মাত্র সবার হৃদয়ে ধারণ করা পুণ্য প্রাপ্তির সমান বলে আমার বিশ্বাসের ভিত,

এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর
পুণ্য হলো অঙ্গ মম, ধন্য হলো অন্তর,
সুন্দর , হে সুন্দর!