ফ্লোরিডা-দর্শন

পরিবারের সবাইকে নিয়ে একদিন ফ্লোরিডা ভ্রমণে বেড়িয়ে পরলাম। আটলান্টিকের পাদদেশে গড়ে ওঠা সমুদ্রবেষ্টিত এই রাজ্যটি প্রকৃতির এক অপরূপ নান্দনিকতার সমাহার, বিমান থেকে নিচে তাকাতেই মনে হলো আটলান্টিকের অথই জলরাশি ধুয়েমুছে দিচ্ছে সারা রাজ্যের শরীর আর সবুজ দুর্বা ঘাসের গা খানা। উদ্দেশ্যে ছিল ফ্লোরিডার দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে দেখে আমেরিকার ইতিহাসকে নিজের কাছে সমৃদ্ধ করা। ফটমায়ার্সের ছোট শহর লিহাই একার্স। আমার বড় মেয়ে তাহমিনা ওই শহরে তার স্বামীর সঙ্গে প্রায় এক যুগ ধরে বসবাস করছে, এই সুবাদে মেয়ের বাসায় যাত্রাবিরতি।
পর দিন ভোরের সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেরিয়ে পড়ার পালা, গন্তব্য আগেই ঠিক করা ছিল। নতুন মডেলের মিনিভ্যানের সব আসন পূর্ণ করে যাত্রী সংকুলান হলো। চালকের দায়িত্ব নিল আলাল অর্থাৎ আমার ছোট মেয়ে রোমানার জামাই। বড় মেয়ের স্বামী বদরুল সবাইকে গাইড করার দায়িত্ব নিল। নির্ধারিত গন্তব্য ছিল কেনেডি স্পেস সেন্টার। সাড়ে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ। মাঝপথে হঠাৎ তাহমিনা চিৎকার করে উঠল, মুহূর্তেই সবার দৃষ্টি তার দিকে। গতকাল অর্ধেক রাত ধরে রান্না করা ভুনা খিচুড়ি আনা হয়নি। এত স্বাদের খিচুড়ি কোনো মতেই মিস করা যাবে না। অগত্যা আবার গিয়ে খিচুড়ির পাত্র নিয়ে গন্তব্যের রওনা দিলাম।
ট্রাফিক আইন মাথায় রেখে আলাল গাড়ি চালাচ্ছে কখনো ৪৫-৫০ মাইল বেগে। রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে কমলা বাগান, কাঁচা-পাকা কমলা লেবুর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। হঠাৎ চোখে পড়ল দুপাশের রাস্তায় প্যানথারের (কালো বাঘ) সাইন, রাস্তার দুপাশে সুনসান নীরবতায় দাঁড়িয়ে গভীর জঙ্গল। রাস্তার পাশে ১০-১২ ফুট উঁচু শক্ত জালি তারের বেড়া। বদরুল জানাল, জায়গাটি খুবই ভয়ংকর, বছরে ২/৪টি ঘটনা শোনা যায়। কালো বাঘ কখনো কখনো গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গল্প শুনে দিনদুপুরেও সবার মধ্যে গা ছমছম একটা ভাব লক্ষ করা গেল। ক্ষণিকের জন্য সবাই চুপ। এভাবে কিছু দূর এগোতেই বদরুলের নতুন চমক, পাশেই নাকি আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ডাক ঘরের অবস্থান, ক্ষণিকের মধ্যেই কালো বাঘের ভয় সবার মন থেকে উবে গেল। এখন সবাই ক্ষুদ্রতম ডাকঘর দেখতেই উদ্গ্রীব। ওচপি নামক এরিয়ার ৪১ নম্বর রোডে পাওয়া গেল সেই ডাকঘর। ওই সময় অফিশিয়াল কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভেতরটা দেখা সম্ভব হয়নি। তবে বাইরে থেকে বোঝা গেল, এটি পূর্ণাঙ্গ ডাকঘর। আমার ধারণা, একজনই এখানে সব কাজ করেন। আবার গাড়ি চলল, রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ জলরাশি। বিশাল জলাশয়ে মাঝে মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে কুমির আর সাপসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। আমাদের সুন্দর বনে যেমন শ্রুত আছে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, ফ্লোরিডার পারিপার্শ্বিকতাও আমার কাছে তেমন মনে হল। আমার মেয়ে তাহমিনা বলল, তাদের বাড়ির পেছনে যে জলাশয় আছে, সেখানেও নাকি কুমির দেখা যায়, কখনো কখনো কুমির ডাঙায় উঠে রোদ পোহায়।
আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর রাস্তার বাঁ পাশে দেখা গেল কিছু প্রাচীন বসতি। বদরুল বলল, আমেরিকার আদিবাসীদের (রেড ইন্ডিয়ান) বসতি এখানে। যুগ যুগ ধরে তাঁদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে তারা এখানে বসবাস করছে। দূর থেকে দেখেই মনে হয়, আধুনিক বিশ্বের আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের কখনো স্পর্শ করেনি। আমেরিকার সর্বশেষ আদম শুমারি থেকে জানা যায়, এখন ৪৫ লাখ অর্থাৎ আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫ শতাংশ নেটিভ আমেরিকান (রেড ইন্ডিয়ান) রয়েছে।
ইতিমধ্যে আমরা কেনেডি স্পেস সেন্টারের অনেকটা কাছে চলে এসেছি। আবছা আবছা ভাসছে স্বপ্নিল শাটল আর রকেটের ছবি। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে অ্যাপোলো ১১ যখন তিন নভচারী নিয়ে চাঁদের দেশে পৌঁছায়, তখন থেকে চাঁদের প্রতি মানুষের পুরোনো গাল-গল্পের অনেকটা অবসান হয়। নেইল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্সরা হয়ে গেলেন বিশ্বের নতুন হিরো। কেনেডি স্পেস সেন্টার চালু হয় ১৯৬৮ সালে। এত দিন গণমাধ্যম আর টিভি পর্দায় দেখেছি। আজ চোখের সামনে সবকিছু দেখে কল্পনা আর বাস্তবের সমন্বয় ঘটাতে বারবার নিজেকে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিতে হলো। প্রথম ফটকের সামনে যেতেই নজরে এল নভোচারীর পোশাক পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, দর্শকদের আকৃষ্ট করার অভিনব পন্থা। ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট গরম উপেক্ষা করেও ঐতিহ্যকে কি চমৎকারভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। পাশে শাটল, এটি নাকি মূল যানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে তারপর এক সময় ফিরে আসে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায়, সবই ধারা বর্ণনা করে যাচ্ছে আর মুভির মতো দেখাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে মনে হলো কখন জানি রূপকথার রাজ্যে রকেটে চড়ে পাড়ি জমিয়েছি।

এতক্ষণে নাসা স্পেস শাটল ফাইনাল ভয়েস আটলান্টিক স্পেস লাউন্স দেখার সময় হয়ে গেল। দৌড়ে চলে এলাম ক্ষণিকের পথ, তিন তলা ভবনের হলওয়েতে বিরাট ডালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে থ্রি ডি চশমাগুলো, সবাই একটা করে নিচ্ছে আর তাড়াহুড়া করে ভেতরে ঢুকছে, আমরাও তাই করলাম।
ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে ওঠার জোগার, বিরাট হল ঘরের সামনের পুরো দেয়ালটাই একটা থিয়েটার পর্দা। ছবিগুলো যেন দর্শকদের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ছোট বেলা থার্ড ক্লাসের টিকিট কেটে যেভাবে ম্যাটিনি শোতে ইংলিশ ছবি দেখতাম, আমার কাছে অনেকটা সে রকমই মনে হলো। আমরা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো ক্রুদের বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান পর্ব, পোশাকের সঙ্গে বিশেষ ধরনের হেলমেট পরে চারজন ক্রু বিশেষ একটা বাসে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাসটি আটলান্টিক স্পেস শাটলের কাছে নিয়ে যাবে। তিনটি রকেটের সংযোগকারী শাটলটি এক সময় ছুটতে লাগল বিরাট অগ্নিকুণ্ডলীর সৃষ্টি করে। হলভর্তি দর্শক সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কেউই যেন চোখের পলক ফেলে কিছু মিস করতে চান না।
এক সময় ভাষ্যকারের ধারা বর্ণনায় শোনা গেল, একজন নভোচারী মধ্যাকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠে জাম্প করবে। স্পেস শাটলটি তখন মধ্যাকাশে ২৮ হাজার ফুট ওপরে, এক সময় মনে হলো কিছু একটা ভূপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে আসছে। মুহূর্ত কালক্ষেপণে প্যারাসুটবাহী নভোচারী চলে আসলেন যেন হল ভর্তি দর্শকদের মাঝে। এটা তার আকাশ জয় না বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ তা আমার বোধগম্য হল না। কেনেডি স্পেস সেন্টারের ভেতরে দিনটা কেটে গেল। বের হয়ে দেখি বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ মনে হলো আটলান্টিকের তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম সমুদ্র তীরে। সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল যেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি উত্তপ্ত সূর্যটাকে এক্ষুনি শীতল গহ্বরে বিলীন করে দেবে। সন্ধ্যা নামলে মনে হল, এখন ঘরে ফেরার পালা। সবাই ভীষণ ক্লান্ত আবার চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে ফিরতে হবে।
পরদিন যাব অরলেন্ডোতে ডিজনি ওয়ার্ল্ড দেখতে। আলাল প্রস্তাব দিল, ঘরে ফেরার কোনো যুক্তি নেই। তার চেয়ে বরং রাতটা আমরা কোনো হোটেলে কাটিয়ে দেব। এতে বাড়তি ড্রাইভ থেকে বাঁচা যাবে। তা ছাড়া ডিজনি ওয়ার্ল্ডে সকাল সকাল ঢুকতে না পারলে সবকিছু দেখা যাবে না। তৎক্ষণাৎ অনলাইনে হোটেল বুকিং দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। সবাই ভীষণ ক্ষুধার্ত, রাত তখন দশটা। মফস্বল শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, ম্যাকডোলান্ডে নৈশভোজে কেউই অভ্যস্ত নয়। অনলাইনে দেশি খাবারের খোঁজাখুঁজি। প্রায় ২০ মিনিট ড্রাইভের দূরত্বে একটি দক্ষিণ ভারতীয় রেস্টুরেন্টের খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু বসে খাওয়া যাবে না, শুধু অর্ডার দেওয়া যাবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাবার পিকআপ করতে হবে। সব শর্ত মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
রাঙা প্রভাতে আনুষঙ্গিক কাজ সেরে সবাই বেরিয়ে পড়লাম। কিছু দূর এগোতেই বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে ডিজনি ল্যান্ডের সাইন। তখন নাতি-নাতনির কী খুশি, তা বর্ণনা করা মুশকিল। বোঝা গেল, আইপেডে দেখা কার্টুনগুলো এখন বিলবোর্ড বাস্তবে উঠে এসেছে। ডিজনির সামনে জলাশয়ের পাশে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা, ওখান থেকে নৌকায় বা ট্রেনের ডিজনি ল্যান্ডে প্রবেশ করতে হয়। আমরা নৌকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নৌকায় যাত্রীরা কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে পারিপার্শ্বিক নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এক সময় পৌঁছে গেলাম। তারপর শুরু হলো পছন্দ মতো রাইড ব্যবহারের পালা। একটা রাইড আমার খুব আনন্দদায়ক মনে হয়েছে। পাহাড় ঘেরা দীর্ঘ নদী পথ, ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন মিট মিট করে কিছু আলো জ্বলছে আকাশের তারার মতো। নদীতে রাখা হয়েছে মৃদু স্রোত, এরই মধ্যে রাখা আছে বিশাল লম্বা ডিঙি নৌকা, এক ডজন লোক বসার ব্যবস্থা করে খণ্ড খণ্ড আকারে নৌকাটি তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সাহায্যে নৌকাগুলো চলছে মনে হয়। ছোট্ট নদীর দুধারে কারুশিল্পের চমৎকার নির্দেশনা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শৈল্পিক স্থাপনা এক এক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের জাতীয় পোশাক পরিহিত মূর্তিগুলো গানের তালে তালে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে এবং দুলছে, এ যেন এক স্বপ্নপুরীর বিমোহিত ভাব। স্বপ্নের ঘোর কাটতে কাটতেই পয়সা হজম, তির্যক আলোর ঝলকানিতে আমাদের রাইডের সমাপ্তি।
এখনো বাকি সমাপ্তি প্যারেড, শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবাই এক সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একসময় প্যারেড স্থলে পৌঁছলাম। রাস্তার দুপাশে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে উৎফুল্ল জনতা। দূর থেকে মনে হল প্যারেডের মাঝখানে দুটো বিরাট তালগাছ হেলেদুলে সামনে এগিয়ে আসছে, সামনে এগোতেই দেখি লম্বা লম্বা পা ফেলে এক জোড়া মানব-মানবি দুলতে দুলতে হেঁটে চলেছে যেন সার্কাসের জোকার। ব্যতিক্রমী বাদ্যের তালে তালে প্যারেড এগিয়ে চলেছে জনস্রোতের মধ্যমণি হয়ে। শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখি, বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা জানান দিচ্ছে প্রস্থানের ইঙ্গিত। একটু এগিয়ে নজরে এল ডিজনি রেলওয়ের বিরাট স্টেশন, ঘর মুখো জনতার লাইন, দুর থেকে কানে ভেসে এল, পুরোনো আমলের কয়লা চালিত ইঞ্জিন মৃদু মধুর শব্দ সবাই জানান দিল, ট্রেন সবার পদযুগলের নাগালে। সবাই ট্রেনে চড়ে বসলাম। সত্যিই এক অপরূপ ট্রেন বাইরের দৃশ্যগুলো একদম পুরোনো ধাঁচে গড়া গাছপালা ছোট ছোট নালা বন্যপ্রাণীর কিছু মূর্তিময় বাস্তবতার ছাপ মুহূর্তেই যেন রূপ কথার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে একসময় ট্রেনের যাত্রা বিরতি হলো। ট্রেন থেকে নেমে খানিক পথ পার হয়ে আমাদের গাড়ির কাছে পৌঁছলাম।