বন্যায় ভয়াবহ এক রাতের অভিজ্ঞতা

সড়কে বন্যার পানিতে ডুবে আছে গাড়ি।

হ্যারিকেন আইডার প্রভাবে ১ সেপ্টেম্বর রাত নয়টা থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় নিউইয়র্ক সিটি ও নিউজার্সি এলাকায়। যদিও এই হ্যারিকেন আইডা নিয়ে আগে সংকেত দেওয়া হয়েছিল। তবে শহরবাসী ধারণা করতে পারেনি, পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ রূপ নেবে। এই বন্যার আগে ১৯২৭ সালের গ্রেট মিসিসিপি বন্যা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বন্যা।

রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টিপাত ও হ্যারিকেন আইডার প্রভাবে সৃষ্ট বিপজ্জনক আকস্মিক বন্যা দ্রুত অনেক রাস্তা, মহাসড়ক, পাতাল রেল স্টেশন এবং বাড়িঘর প্লাবিত করে ফেলে। এতে অনেকের প্রাণহানি হয়েছে।

গাড়ি নিয়ে বন্যার পানিতে আটকে পড়া কুইন্সের ফ্লাশিংয়ে বসবাসরত ইয়েলো ক্যাবচালক ইমরান সাদাত বলেন, ‘যাত্রী নামিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরার পথে আমি গাড়িতে আটকা পড়ে যাই প্রিন্স স্ট্রিট ও নর্দান বুলেভার্দে। অল্প কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কীভাবে এমন তুমুল বর্ষণ ও বন্যা শুরু হলো তা এখনো বোধগম্য হচ্ছে না।

কুইন্সে বসবাসরত ড্রাম সংগঠনের সদস্য ফরিদা শিরিন খান বলেন, ‘সেদিন আমি বেভারলি রোডের নোয়াখালী সমিতি অফিসে ড্রাম মেম্বার রুবির বাসায় ছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজ পেলাম, বাইরে তাকিয়ে দেখি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমলে বাসার দিকে রওনা দিই। কিন্তু সামান্য পথ আসার পর আবার শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। ভিজে ভিজে কোনো রকমে বাসায় ফিরেছি। প্রচণ্ড অস্থিরতায় রাতের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে।’

কুইন্সের মাসুম আহমেদ বলেন, ‘সেদিন রাতে আমার বেসমেন্টে পানি ঢুকে যায়। মাঝ রাত পর্যন্ত পানি ফেলছি, আবার একটু ঘুমিয়ে ভোরে উঠে পানি ফেলেছি। ভয়ানক পরিস্থিতি, খুবই আতঙ্কে রাত কেটেছে। পানি ফেলতে গিয়ে ব্যাকপেইন শুরু হয়েছে। ঠান্ডা লেগেছে।

সাপ্তাহিক পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক নাজমুল আহসান আটকা পড়েন সাবওয়েতে। চার ঘণ্টা পরে তিনি ঘরে ফিরতে পেরেছেন।

সেদিন রাতে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির ট্রেনে আটকা পড়া মানুষগুলোর অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ক্যামিলা আকবরী নামের একজন সেই রাতে নিউইয়র্ক পেন স্টেশন থেকে নিউজার্সির প্রিন্সটনে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হন। কিন্তু হ্যারিকেন আইডার প্রভাবে তিনি ট্রেনে এক ঘণ্টার যাত্রাপথ ১৪ ঘণ্টায় পার করেন। মুষলধারে বৃষ্টি ও বন্যার মধ্যে ২৪ বছর বয়সী নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল’ স্কুলের ছাত্র আকবরী বিদ্যুৎ, বায়ু চলাচল, খাবার এবং পানি ছাড়া ট্রেনে রাত কাটান।

আইডার এই ভয়াবহ তাণ্ডবে বাড়ি ফেরার পথে আটকা পড়ে যাই আমিও। সঙ্গে ছিল আমার ছেলে। আমি যখন সংকেত পাই তখন সময়টা ছিল রাত নয়টা। বলা হলো রাত ১২টার দিকে হ্যারিকেন আইডা আঘাত হানবে। সংকেত পেয়েই ছেলের অবস্থান ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। তখন ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে বৃষ্টি রূপান্তরিত হলো ভারী বর্ষণে। দোকান-পাট সব বন্ধ করে দেওয়ায় কোনো বাড়তি আলো চোখে পড়ছিল না, শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া।

আমি তখন নর্দান বুলেভার্দে। দ্রুত গাড়ি নিয়ে রুজভেল্ট অ্যাভিনিউয়ের দিকে যেতে শুরু করলাম। ভাবলাম, সেখানে হয়তো মাথার ওপরে রেললাইন থাকায় বৃষ্টি কিছুটা কম হবে। অন্ধকারে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গাড়িটা রুজভেল্ট অ্যাভিনিউ মোড়ে ঘোরালাম, ভয়ানক এক অকল্পনীয় স্রোতের মধ্যে পড়ে গেলাম। যত দুর চোখ গেল, পুরো রুজভেল্ট বন্যা প্লাবিত। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে গেল। ধীরে ধীরে গাড়িটি বন্যার পানিতে ডুবতে লাগল। রাত তখন সাড়ে নয়টা।

চারপাশে গাড়ি দুর্ঘটনা দেখলাম। চারটা গাড়ি ডুবে আছে, নড়ছে না। দুইটা মোটরসাইকেল ও গার্বেজ ব্যাগ পানিতে ভাসছে। একটা ছোট গাড়িও পানিতে ভাসতে। একদিকে পুলিশের দুইটা গাড়ি আধো ডোবা হয়ে আছে। কয়েকটি গাড়ি তখনো হেডলাইটের আলোয় অনুমানের ওপর একে অন্যের গাড়ির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। গাড়ির দরজা খোলার অবস্থা ছিল না কারও, বন্যার পানি গাড়ির জানালা বরাবর। ভয়ানক আতঙ্ক নিয়ে তখন আমি কেবল ছেলেকে নিয়ে বেঁচে যাওয়ার প্রার্থনা করছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ সময়।

অবশেষে ৯১১-এ কল করে পুলিশের সাহায্য নিলাম। অন্ধকার ও প্রবল বর্ষণে স্ট্রিট অ্যাড্রেস দেখতে না পেয়ে পুলিশের নির্দেশনায় গুগল লোকেশনে খুঁজে দিলাম তাঁদের। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গাড়ি হাজির। পুলিশের সহায়তায় গাড়ি ঠেলে মোটামুটি একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছালাম। যখন গাড়ি থেকে বের হলাম, ভারী বর্ষণে আমাদের শরীর ভিজে একাকার। প্রায় দেড় ঘণ্টা এ তাণ্ডব মোকাবিলা করতে হয়েছিল ডুবন্ত গাড়িতে বসে।

পুলিশের দায়িত্ব দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছি। কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে তাঁরা ভেজা শরীরে আমাদের মতো জীবনের ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে রক্ষা করতে তৎপর ছিলেন। কমিউনিটি সেবক হিসেবে তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা ও স্যালুট জানাই।

হ্যারিকেন আইডার প্রভাবে স্থানীয় সময় বুধবার রাত থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় নিউইয়র্ক সিটি এবং নিউজার্সি সহ আরও কিছু রাজ্যে। সে সময় ভারী বর্ষণের কারণে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেল ও পাতাল রেল সেবা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি কর্তৃপক্ষ। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভানিয়া ও কানেকটিকাটসহ যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি অঙ্গরাজ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। নিউইয়র্ক শহরের কুইন্সের বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর অন্তত ডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিউজার্সিতেই মারা গেছে অন্তত ২৭ জন।