বহিষ্কার মানে সব শেষ নয়
>

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, জীবনটাই বোধ হয় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বহিষ্কারের পর আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছেন ও ফেরার অপেক্ষায় আছেন এমন দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছেন সাহেদ আলম
‘অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছি’
প্রায় ১৩ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছেন সিলেটের আবু সাঈদ চৌধুরী। এখন থাকেন নিউজার্সির নর্থ ব্রান্সউইকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের পর বাংলাদেশে প্রায় ১৩ বছর কাটিয়ে আবার ফিরেছেন এ দেশে। ৬০ বছরের কাছাকাছি এসে আবার নতুন করে জীবন সাজাচ্ছেন তিনি। তবে জীবনে এক দশকের বেশি তাঁকে কাটাতে হয়েছে স্বপ্নের বাইরে, অপেক্ষায় অপেক্ষায়।
বললেন, ‘২০০৫ সালের ২৮ এপ্রিল আমার বাসা থেকে সাদাপোশাকের দুই পুলিশ আমাকে আটক করেছিল। সেই রাতে আমি একাই বাসায় ছিলাম। আমার বুকের ভেতরে দেড় বছরের ছোট ছেলে তখন ঘুমিয়ে। আর পায়ে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল আড়াই বছরের ছেলেটি। ১৮ দিনের মতো ডিটেনশন সেন্টারে ছিলাম। এরপরে, আমাকে প্লেনে তুলে দিল। আমি তাদের বলেছিলাম, আমাকে একটা সপ্তাহ সময় দেন, ওরা দেয়নি।’
-কী বলেছিল দেশে ফেরত পাঠানোর সময়?
‘আসলে আমি আগে থেকেই ডেপুটেশনে (বর্ধিত সময়ে অবস্থান) ছিলাম। আমি জানতাম, একদিন ফিরে যেতে হবে। ওরা যাওয়ার সময় বলেছিল, তুমি আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশে ফিরতে পারবে না। এর আগে যদি ঢোকো, তাহলে আরও ১০ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হবে।’
-কেন আপনাকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছিল?
‘সবার যে কারণে হয়, সেটা আমারও হয়েছিল। আমি এই দেশে আসি ১৯৯০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। আমি একজন কাগজপত্রহীন হিসেবেই ছিলাম। পরে এই দেশে নাগরিক এক নারীকে বিয়ে করি। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি বলে আমার চলে যাওয়ার নির্দেশ ছিল। পরে ২০০১ সালে আমি যখন আসল বিয়ে করলাম। আমার স্ত্রীর নাগরিকত্বের সুবাদে আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের ৫ দিনের মাথায় আমার বহিষ্কারের নির্দেশ জারি হয়। এরপর ডেপুটেশন করে বাকি সময় থাকতে পারি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তো ফেরত যেতে হয়েছিল।’
-আবার কীভাবে ফিরলেন?
‘অনেকটা মিরাকল বলতে পারেন। অবশ্য আইনি পথেই এগিয়েছিলাম আমি। আমাকে যখন ২০০৫ সালে ফেরত পাঠানো হয়, তখন আমার স্ত্রীর নাগরিকত্বের সনদ প্রায় হয়ে যাবে এমন একটা সময় ছিল। আমাকে ফেরত পাঠানোর পর আমার স্ত্রী বাংলাদেশে গিয়ে আমার সঙ্গে ছিলেন। এরপর তিনি এখানে ফিরে নাগরিকত্ব নিয়ে একটানা তিন বছর এখানে বসবাস করেন। আমার দুই ছেলেও তখন তাঁর কাছেই ছিল। এরপরে সে আমার কাছে চলে যায় এবং আট বছর বাংলাদেশেই ছিলাম আমরা একত্রে। আমার ছেলেরা বাংলাদেশের স্কুলেই পড়েছে। এখন আবার এখানে ফিরে এসেছে আমার সঙ্গে। একজনের বয়স ১৫ বছর আর আরেকজনের বয়স ১৬ বছর।’
–দেশে কী করতেন?
‘১২ বছর ১০ মাস ছিলাম দেশে। এই সময়টা বেশ কষ্টের ছিল আমার জন্য। অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মন বসাতে পারিনি কোনো কিছুতেই। কোনো কিছুই সফলভাবে করতে পারিনি। জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময়টিতে আমি দোটানায় ছিলাম। এটা আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। কেননা একজন মানুষ জীবনে ৩০ থেকে ৪০-৫০ বছরের মধ্যেই তার উন্নতি ব্যবসা, ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। সেই সময়টাতে আমি পিছিয়ে পড়েছিলাম। এখন আবার ফিরে এসেছি, কিন্তু স্বপ্ন আর বেঁচে নেই।’
-আবার ফিরে এলেন কীভাবে? বাধা দেয়নি ওরা?
‘এবার, ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আবার আমি ইমিগ্র্যান্ট ভিসার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর সিটিজেনশিপের মাধ্যমে আমি স্পাউস ভিসা পেয়ে আবার ঢুকি এ দেশে। আমার একটি ক্রিমিনাল কেস ছিল। স্থানীয় ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে ২০০১-এ গ্রেপ্তার একবার হয়েছিলাম। সেই রেকর্ড দেখতে চেয়েছিল ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। দেখিয়েছিলাম। কোনো সমস্যা হয়নি।’
-ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কী বলার আছে। এই বয়সে নতুন করে কিছু ভাবা সহজ না। মোটামুটি কাজ করে জীবনধারণ করার চেষ্টা করছি।’
-বহিষ্কার নিয়ে কিছু বলার আছে?
‘আমি বিশ্বাস করি, বহিষ্কারের কবলে যাঁরা পড়ছেন, তার অর্থ এই নয় যে জীবন শেষ। হয়তো স্বপ্ন ও সময়ে ছেদ পড়ে, তবে আবার ফিরে আসা যায়। এইভাবে যারা বহিষ্কৃত হয়েছে, তাদের যদি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে, তাদের সবারই ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। আমি যে আবার ফিরে আসতে পারব, সেটা আমি ভাবিনি। এটা একটা মিরাকল এবং এই মিরাকল সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে।’
দিন গুনছেন কাজী আরজু
দীর্ঘ ২৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর বাংলাদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন নিউইয়র্কের জ্যামাইকার হলিসের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী কাজী আজাদ আরজু। এর আগে ১০ জানুয়ারি তাঁকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আদালত থেকে গ্রেপ্তার করে। মাসখানেক ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী থাকার পর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেই তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। জ্যামাইকার বাড়িতে তখনো তাঁর ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনেরা।
দেশে ফেরত পাঠানোর পর পরিস্থিতি বুঝে উঠতে বেশ কিছুদিন সময় নেন আরজু। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে নিজের প্রথম একটি ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি মুখে বিমানবন্দর থেকে ফিরছেন গাড়িতে করে।
নিউইয়র্কে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আর দেশে পারিবারিক সচ্ছলতার কারণে তাঁকে হয়তো আর্থিক সংগ্রাম করতে হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আছে অন্য লড়াই। ১০ এপ্রিল যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয় তখন বাংলাদেশে ভোররাত।
-কেমন আছেন?
‘ভালো আছি, এখন মশা মারছি’ (শোনা যচ্ছিল মশা মারার শব্দ)
-কেমন কাটছে এখন?
(একটু চুপ থেকে) ‘এই তো, কেটে যাচ্ছে। এখানে তো এখনো শরীর, মন—কোনোটাই বসাতে পারিনি। দীর্ঘ ২৮ বছরের এক অভ্যস্ত জীবন ফেলে এসেছি নিউইয়র্কে। এখন ঘুমানোর কথা, কিন্তু মশা মারতে হচ্ছে, ঘুমাতে পারছি না। আমার মন পড়ে আছে বাচ্চাদের কাছে। কবে ফিরব সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছি।’
-কবে ফিরবেন বলে জানছেন আপনি?
‘আমার আইনজীবী জানিয়েছেন, আড়াই বছর লাগতে পারে। হয়তো একটু বেশিও লাগতে পারে। তবে, দুই বছর পরেই আমি আবার ইমিগ্র্যান্ট ভিসার জন্য দাঁড়াতে পারব। আমার স্ত্রী যেহেতু আমেরিকার নাগরিক। আর এমনিতেই আমার গ্রিনকার্ড আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন ছিল, তাই এখন দুই বছরের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আমি আবার আবেদন করতে পারব বলে জানিয়েছেন আমার আইনজীবী।’
-দু বছর পরেই তাহলে ফিরতে পারবেন?
‘দেখা যাক। প্রথমবার ভিসার জন্য দাঁড়ালে ঢাকার দূতাবাস আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে বলে জানানো হয়েছে। সেই প্রত্যাখ্যানপত্র নিয়ে আমেরিকায় আবার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সেটা নিয়ে দ্বিতীয়বার দাঁড়ালেও আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে বলে জেনেছি। কিন্তু আমি যে আবার ফিরে আসতে পারব সেটা নিশ্চিত। কেননা, এটা আইনে স্বীকৃত। আর আমি আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত দিন থাকিনি।’
-স্ত্রী, সন্তানদের অনেক দিন মনে হয় দেখেননি?
‘প্রতিটি সময় আমি ওদের সঙ্গেই থাকি। স্পর্শ করতে পারি না শুধু। আমার স্ত্রী চেয়েছিলেন সন্তানদের নিয়ে এখানে চলে আসতে। কিন্তু তাতে ওদের পড়াশোনার সমস্যা হবে। আমি বলেছি গ্রীষ্মের ছুটিটা আমার এখানে কাটিয়ে যেতে। ওরা টিকিট কেটে ফেলেছে, গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই মাস এখানে থাকবে। সেই সময়টা ভালো কাটবে আশা করছি।’
-দেশে কিছু করার চেষ্টা করছেন?
‘কীভাবে সম্ভব? আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুই আমার সঙ্গে নেই। এখানকার সিস্টেম বা রাষ্ট্রযন্ত্র অথবা মানুষের লেনদেন রীতি আমার আগের জায়গা থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানে গায়ের জোর আর অনিয়মই নিয়ম। সেটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি কটা দিনের জন্য। কিন্তু আমি ফিরব সহসাই এবং সেদিনের অপেক্ষা করছি। আমার মূল ব্যবসা এখনো নিউইয়র্কে এবং আমি না থাকলেও আমার ব্যবসায়িক পার্টনাররা সেটা চালিয়ে নিচ্ছেন।’
-কিছু বলার আছে আপনার বহিষ্কার নিয়ে?
‘এটা অমানবিক। আমাকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে আইনি সুরক্ষা থেকে। আমার বাচ্চাদের কঠিন সময়ের মুখোমুখি করা হয়েছে। এটা আর কারও ক্ষেত্রে না হোক, এটাই কামনা করি। এটা একটা বড় শাস্তি। এই শাস্তি কেউ না পাক।’
কাজী আরজুরও ফিরে আসার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার। অভিবাসন আইনে সেটাই উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছেন একজন আইনজীবী। স্বাভাবিকভাবে বহিষ্কারের ক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত আসার কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করা থাকে, তাহলে এক বছর অতিরিক্ত অবস্থানের শাস্তি দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা। দুই বছর অতিরিক্ত অবস্থানের কারণে চার বছর না ফিরতে পারার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞা হয় ১০ বছরের। সেই ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা পার করেও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন অনেক বহিষ্কৃত ব্যক্তি।