বাংলাদেশের গৃহবধূ প্রবাসে অদম্য কর্মী

বাংলাদেশে যে নারী ছিলেন গৃহবধূ, প্রবাসে এসে তাঁদের অনেকেই ধরেছেন পরিবারের হাল। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি প্রবাসী নারীরা ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, ট্রেন চালাচ্ছেন, বিপণি বিতানে কাজ করছেন রাত দিন। স্বামী সংসার সামাল দিয়ে প্রবাসী নারীদের কাজ দেখলে ধারণা করা যাবে না, দেশে কী জীবন ফেলে এসেছেন এসব নারী। 

ডাকসাইটে আমলার স্ত্রী ছিলেন, কেউ ছিলেন বিত্তবান চেয়ারম্যানের মেয়ে। ধারণাই ছিল না, কোনো দিন নিজে কাজ করে সংসারের হাল ধরতে হবে। কর্ম সংস্কৃতির দেশ আমেরিকায় এসে এসব গৃহবধূরা অনন্য হয়ে উঠেছেন।
অর্থের প্রয়োজন ছোট-বড় ভিন্ন ভিন্ন পেশায় প্রবাসে বাংলাদেশি নারীরা দিন রাতে কাজ করছেন। প্রবাসী স্বামী তথা পরিবারের কিংবা স্বদেশে থাকা পিতামাতা-ভাইবোনের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কাজ করার জন্য তাদের অভিমান বা অভিযোগ নেই। প্রবাসের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে হাসিমুখে খেটে চলেছেন প্রতিনিয়ত। দেশের মেকি আভিজাত্যের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। বড় কাজ, ছোট কাজ-কিছুই করতে দ্বিধা করছেন না প্রবাসী নারীরা।
চেয়ারম্যানের মেয়ে ছিলেন এস্টোরিয়া প্রবাসী রাহেলা খাতুন। নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালিয়ে বাড়ি কিনেছেন। সন্তানদের কলেজে পড়াচ্ছেন। প্রথম আলোকে বললেন, স্মরণেও আনতে চাই না, কোন পরিবেশে বড় হয়েছি। আমেরিকান স্বামীর সঙ্গে বিয়ের পরের কিছুদিনের গল্পের কথা শোনালেন।
সেই সব গল্পে আমেরিকার বিলাস-বহুল জীবনের রূপকল্প ছিল। নানা ধরনের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হওয়ার মতো কাহিনি ছিল। নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ার থেকে ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ডসহ আমেরিকার অঙ্গরাজ্যের কোথায় কোথায় স্বর্গের মতো জায়গা আছে, সেগুলো ভ্রমণের আশ্বাসও ছিল।
রাহেলা জানালেন, একে অপরের হাতে হাত রেখে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন জীবনের প্রত্যেকটি আনন্দ, দুঃখ-কষ্টে, অংশীদার হবেন।
অভিবাসনে আমেরিকায় এসে দেখেন, আড্ডা আর আনন্দ ভ্রমণ হারিয়ে গেছে। কারণ বিয়ের বছরের দেনাগুলো শোধ হয়নি। ব্যক্তিগত ক্রেডিট কার্ডের বিলও দিন দিন ভারী হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের সামাজিক নিয়মে দেশে মা-বাবা, ভাইবোনের বিভিন্ন ধরনের খরচাদির জোগান দিতে হয় স্বামীকে। প্রথমদিকে স্ত্রী না বুঝলেও দু-চার মাসের মধ্যে স্বামীর আয়-ব্যয়ের অনুমান করতে সক্ষম হন রাহেলা বেগম। নিজেই নামেন কাজের সন্ধানে। বুঝতে পারেন সংসার কারও একার নয়।
এই গল্প শুধু রাহেলা বেগমের নয়। নিউইয়র্কের প্রতিটি প্রবাসী এলাকায় বাংলাদেশি এমন নারীদের দেখা মেলে। যারা স্বামীকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা নিয়ে স্বামীর অজান্তেই কাজকর্ম খুঁজতে থাকেন। অনেকেই আবার পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার অনুমতি আদায় করেন। বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতা গৃহবধূরা কেউ ডানকিন ডোনাটস, মেগডোনাল্ডস, বিভিন্ন খাবারের দোকানে, ছোটবড় দোকান-সুপারমার্কেট, ডাক্তারদের চেম্বারে কাজ খুঁজছেন। এমনকি নিজ ঘরে বসেই সেলাইের কাজ করছেন অনেকে।
দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আমাদের প্রবাসী নারীদের নিয়ে নানা হইচই শুরু হয়। কিন্তু একটু নজর দিলেই দেখা যায় আমাদের পশ্চাৎপদ গ্রাম থেকে আসা নারীরাও আমেরিকায় এসে মূলধারার কর্ম প্রবাহে ঢুকে গেছেন। পরিশ্রমের প্রবাস জীবনে কোনো অভিযোগ ছাড়াই সংসারের হাল ধরছেন স্বামীর সঙ্গে। এ যেন এক জীবনের যৌথ সংগ্রাম। সংসার সামাল দিয়ে আমাদের প্রবাসী নারীরা এ যৌথ সংগ্রাম করছেন সাহসের সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে।